সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হেফাজতে ইসলাম সমর্থকদের হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় দুটি পৃথক মামলা হলেও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কোনো অপরাধী গ্রেপ্তার হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
একটি মামলা করেছে পুলিশ, আরেকটি করেছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল। এই দুটি মামলায় আসামির নাম, পরিচয় ও সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো।
মামলায় আসামি কারা বা কতজন—এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “তদন্তের স্বার্থে এখনই মামলার সব তথ্য বলছি না। তবে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, অপরাধীরা পার পাবে না।”
বৃহস্পতিবার শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ।
তাঁরা সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। আক্রান্ত এলাকায় পুলিশ এবং র্যাব সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
“অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে,” বলেন র্যাব প্রধান।
গত সোমবার শাল্লার পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা বাবুনগরী এবং যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন। মামুনুল হক মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এ জন্য তাঁর সমালোচনা করে ফেসবুকে মন্তব্য লিখেছিলেন নোওয়াগাঁয়ের হিন্দু ধর্মাবলম্বী তরুণ ঝুমন দাস।
এ নিয়ে মঙ্গলবার থেকেই হেফাজত সমর্থকেরা উত্তেজনা ছড়ায় এবং এলাকায় মিছিল করে। হামলা থেকে বাঁচার জন্য মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
ঝুমনকে গ্রেপ্তার করে থানায় পাঠানো হলেও বুধবার সকালে হেফাজতে ইসলামের কয়েকশ সমর্থক লাঠিসোটা এবং দা নিয়ে হামলা চালায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে।
এদিকে নোয়াগাঁওয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। এরপর ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন মন্ত্রী।
“ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের আগে এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনায় আমরা সত্যি দুঃখিত। এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। যারাই জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না,” বলেন সরকার দলীয় এই শীর্ষ নেতা।
ফেসবুকে লাইভে হামলার ভিডিও
হিন্দু অধ্যুষিত ওই এলাকায় হামলার জন্য সদলবলে রওনা হওয়ার দৃশ্য ফেসবুকে লাইভে সম্প্রচার করেছিল হামলাকারীরা। বুধবার সকাল আটটার দিকে সম্প্রচারিত লাইভ ভিডিওতে দেখা যায় শত শত যুবক ও কিশোর লাঠিসোটা এবং দা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
এ সময় তারা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’, ‘আল কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’, ‘হেফাজতের অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন, মামুনুল হকের অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ইত্যাদি স্লোগান দেয়।
পুলিশ ও স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, তারা অন্তত ৮০টি বাড়িঘর এবং সাত-আটটি পারিবারিক মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। আক্রান্ত হিন্দুরা প্রাণ রক্ষার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী হাওরে গিয়ে আশ্রয় নেন।
হামলার শিকার অসীম চক্রবর্তী টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “হামলাকারীরা গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা আমার বাড়িঘর ভেঙে মন্দির থেকে একশত বছরের পুরোনো কষ্টি পাথরের মূর্তি নিয়ে গেছে।”
রঞ্জনা চৌধুরী নামে গ্রামের একজন মুদি দোকানদার বেনারকে বলেন, “আমরা আমাদের দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে হাওরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি আমার দোকানের সকল মালামাল ও টাকা পয়সা লুট করে নিয়ে গেছ।”
শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান আল-আমিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমি একটি অনুষ্ঠানে ছিলাম। খবর পাওয়ামাত্র দাড়াইন বাজারে চলে আসি। সেখানে অধিকাংশ বিক্ষোভকারীদের থামাতে পারলেও লুটপাট থামানো যায়নি।”
তবে লুটপাটের বড়ো কোনো অভিযোগ পাননি জানিয়ে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “হামলাকারীরা মূলত গ্রামে ভাংচুর চালিয়েছে। ওই গ্রামের প্রায় সবাই অতি দরিদ্র। তাদের কাছ থেকে লুটপাট করার মতো তেমন কিছু ছিল বলে মনে হয়নি।”
“একজন বলেছে পাঁচ হাজার টাকা এবং আরেকজন বলেছে ৫৮ হাজার টাকা নিয়ে গেছে,” যোগ করেন তিনি।
ঘটনাটি “আকস্মিকভাবে ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে,” শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ওই গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র এক হাজার, সবাই হিন্দু। সবাই দরিদ্র, ফেসবুকে সমালোচনাকারী ঝুমন দাসও দরিদ্র। তাঁকে আটক করায় পরিস্থিতি শান্ত হয়েছিল।
“তারপরও আমরা গ্রামের কাছে যে বাজারটি আছে সেখানে ছয় জন পুলিশ মোতায়েন রেখেছিলাম। আমি রাত আড়াইটা পর্যন্ত খোঁজখবর রেখেছি। রাত আড়াইটায় উপজেলা চেয়ারম্যানকে যখন ফোন করলাম তখন তিনিও বললেন, পরিস্থিতি শান্ত আছে, কিন্তু সকাল বেলা হঠাৎ ঘটনাটি ঘটল।”
“গ্রামের পিছন দিকের একটি ছোট নদী পেরিয়ে হিন্দুগ্রামে হামলা হয়েছে। দূরবর্তী অঞ্চল হলেও পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গেছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে,” বলেন তিনি।
মামুনুল হকের ভিডিও বার্তা
হেফাজত নেতা মামুনুল হকের মন্তব্য জানার জন্য টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি একটি ভিডিও বার্তা পোস্ট করেছেন। ইউটিউবে দেওয়া ১১ মিনিটের ওই ভিডিও বার্তায় তিনি ঘটনার দায় অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেছেন, “স্থানীয় আলেম–ওলামারা বাধা দিলেও হামলাকারীদের থেকে নিবৃত করা যায়নি। তাই কোনও ভাবেই এই ঘটনার দায় আলেম–ওলামাদের উপর চাপানো যাবে না।”
এরকম ঘটনায় আইন হাতে তুলে না নিয়ে পুলিশর প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়ার জন্য তিনি তার অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।