আরও পড়ুন:
Mahesh Rath Yatra 2023: বিনা মেঘে বাজ…মৃত্যু পুরোহিতের! কী রহস্য?
চোখ বাঁধা অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছেন বিদ্যাপতি। পিছনে তাঁর শ্বশুর মশায় শবর রাজা বিশ্ববসু। চলতে চলতে জঙ্গলের মধ্যে এক গুহায় গিয়ে পৌঁছলেন তাঁরা। এ বার জামাইয়ের চোখ খুলে দিলেন বিশ্ববাহু। বিদ্যাপতির সামনে এক অদ্ভুত আকারের দেবতার মূর্তি। তাঁকেই বংশ পরম্পরায় নীলমাধব নামে পুজো করে আসছে স্থানীয় শবররা। নামটা শুনেই চমকে উঠলেন তো?
নীলমাধব তো আসলে জগন্নাথের নাম! আজ রথযাত্রার দিনে সেই নীলমাধবই রথে চড়ে রওনা দেবেন মাসির বাড়ি গুন্ডিচার উদ্দেশ্যে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়, প্রসাদ বিতরণ, সপ্তাহব্যাপী চলতে থাকা মেলা, এই সবের কেন্দ্রে থাকা জগন্নাথ কি আসলে শবরদের দেবতা? এই হিন্দুত্বের দেখনদারির যুগে এমন কথা মাথায় আনাও পাপ। কিন্তু স্কন্দপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, কালিকা পুরাণের প্রাচীন পুঁথি, প্রাচীন আদিবাসী এবং বৌদ্ধ স্থাপত্যে জগন্নাথের এবং ত্রিমূর্তির অবয়ব, এমনকী বর্তমান শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দিরের বেদীর নকশা ভগবান বিষ্ণুর রূপ বলে পুজো হওয়া জগন্নাথের তান্ত্রিক এবং আদিবাসী দেবতা হিসেবে অস্তিত্বের কথা জানান দিয়ে যায়।
সেই সব কথা বলার আগে প্রথমে শুরু হওয়া গল্পটা শেষ করি। এই গল্পটাই স্কন্দপুরাণ এবং ব্রহ্মপুরাণে জগন্নাথ মন্দিরের আদিকথা হিসেবে বলা রয়েছে। বিদ্যাপতি শবররাজ বিশ্ববসু জামাই হলেও তিনি আসলে শবর নন। মেয়ের সঙ্গে প্রেম, তাই মালোয়া থেকে আসা বিদ্যাপতিকে জামাই করতে এক রকম বাধ্য হয়েছিলেন বিশ্ববসু। কিন্তু তা বলে কি বাইরের লোককে নিজেদের দেবতার গোপন অর্চনাস্থল দেখানো যায়? কিন্তু জামাতাও নাছোড়বান্দা। তাই শেষ পর্যন্ত চোখ বেঁধে ওই মন্দিরে তাঁকে নিয়ে গেছিলেন শবররাজ। কিন্তু তিনি জানতেন না, কী ভুল তিনি করছেন।
মন্দিরে নীলমাধবের মূর্তি দেখে বিদ্যাপতির আসল উদ্দেশ্য সফল হল। আসলে বিশ্ববসুর মেয়েকে বিয়ে করা নয়, এই গোপন মন্দিরের খোঁজ পেতেই তাঁর এই অঞ্চলে আসা। তাঁকে পাঠিয়েছেন মালোয়ার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। তিনি নাকি স্বপ্নাদেশ পেয়েই এই কাজ করিয়েছিলেন বিদ্যাপতিকে দিয়ে। চোখ বাঁধা থাকলেও রাস্তা চেনার উপায় আগে থেকেই বের করে রেখেছিলেন বিদ্যাপতি। হাতে করে নিয়ে এসেছিলেন সরষের বীজ। যা পুরো পথেই ফেলতে ফেলতে গিয়েছিলেন তিনি। সময়টা বর্ষাকাল। তাই কিছু দিনের মধ্যেই সরষের চারা গোপন মন্দিরে যাওয়ার পথরেখা তৈরি করে দিল।
ততদিনে শবররাজের জামাই বাবাজীবন বেপাত্তা। কদিন পরেই যে ফিরে এল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে নিয়ে। কিন্তু গুহায় পৌঁছে পাওয়া গেল না মূর্তি। ততদিনে সব বুঝে ফেলেছেন শবররাজ। তবে নীলমাধব আবার স্বপ্নে দেখা দিলেন মালোয়ার রাজাকে, এর পরের গল্প সকলের জানা। সমুদ্রে ভেসে আসা কাঠ দিয়ে সেই স্বপ্নে দেখা মূর্তির নির্মাণ করে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা।
এ তো গেল পুরাণের কথা, যেখানে স্পষ্টভাবেই নীলমাধবের আদিবাসী দেবতা থেকে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের দেবতা হওয়ার কথা মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুরাণের কথায় তো পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। তাই খোঁজ নেওয়া দরকার আরও বিশদে। এ বার আসতে হবে ওডিশার জাজপুরের ললিত গিরির এক প্রাচীন আদিবাসী মন্দিরে। যেখানের স্থাপত্যে ফুটে রয়েছে জগন্নাথের মুখ। পরে এই জায়গাতেই বৌদ্ধদের তান্ত্রিক সাধনা বজ্রযানের অভ্যাসের কথা জানা যায়। আসলে হীনযান এবং মহাযানের পরে স্থানীয় আদিবাসী এবং তন্ত্রাচারের সঙ্গে মিশেই এই বৌদ্ধ তন্ত্রের সৃষ্টি। যেখানে ভৈরব হিসেবে জগন্নাথের অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
এ বার চলে আসুন খোদ জগন্নাথ মন্দিরে। মূল মন্দিরের ঠিক পিছনেই রয়েছে দেবী বিমলার মন্দির। যাকে অন্যতম সতীপীঠ বলে মনে করা হয়। কালিকাপুরাণে উল্লেখ মেলে এই প্রসিদ্ধ তন্ত্রপীঠের। বিমলা দেবীর পূজার মন্ত্রেই রয়েছে,
‘উৎকলা নবী দেশেশ্চ, বিমলা পুরুষোত্তমে, বিমলা ভৈরবী যাত্রা জগনাথাস্তু ভৈরবাঃ’ – অর্থাৎ দেবী বিমলার ভৈরব হলেন জগন্নাথ। এখানেই আরও এক ধন্ধ। ভৈরব মানেই তো শিব। কিন্তু এখানে তাঁর ব্যাতিক্রম কেন?
শুধু মন্ত্রেই নয়, দারুব্রহ্ম জগন্নাথ যে বেদিতে আসীন সেই বেদিতেই আঁকা রয়েছে ভৈরবী চক্র। রত্ন সিংহাসনের মধ্যেও রয়েছে এই ভৈরবী চক্রের অস্তিত্ব। যে চক্র নিজেদের উপচারে ব্যবহার করতেন বজ্রযানের একটি শাখা কালচক্রযানের উপাসকরা। তাঁদের উপাস্য ছিলেন মা বিমলা। আর ভৈরব স্বয়ং জগন্নাথ। জগন্নাথের মূর্তিতে পোশাকের জায়গায় হলুদ বাঘছালের মতো নকশাও তাঁর ভৈরব রূপের সমর্থন করে। জগন্নাথের বীজ মন্ত্রে ‘ক্লিং’ শব্দের উপস্থিতি প্রমাণ করে এই পূজার শাক্ত এবং তান্ত্রিক ঐতিহ্যের। বাংলার কালীপূজার মন্ত্রে এই ‘ক্লিং’ শব্দের উচ্চারণ আমরা সকলেই শুনেছি। যা বিষ্ণুর পূজার ক্ষেত্রে কিন্তু দেখা যায় না।
তা হলে প্রশ্ন, তিনি তন্ত্রের ভৈরব থেকে হঠাৎ বিষ্ণুর অবতার হিসেবে পূজিত হতে শুরু করলেন কী ভাবে? সরাসরি কিছু যোগসূত্র না পেলেও অমরাবতীর বৌদ্ধ ভাস্কর্যে বৌদ্ধদের ত্রিরত্নের একটি ভাস্কর্য এই ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত দিতে পারে। সেখানে বুদ্ধং, সংঘং এবং ধর্মং শরণং গচ্ছামি মন্ত্রের রূপ দেওয়া হয়েছে পাশাপাশি রাখা তিনটি মূর্তিতে। যার আকার পুরোপুরি না হলেও মিলে যায় জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার ত্রিমূর্তির সঙ্গে।
এই মিল থেকেই বোঝা যায় জগন্নাথের মূর্তিতে বৌদ্ধ প্রভাবের কথা। এ বার যদি শঙ্করাচার্যের আমলে প্রচলিত বিষ্ণুর দশাবতারের তালিকা দেখি সেখানেই বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই সেই বৌদ্ধ প্রভাবের ত্রিরত্ন বিষ্ণুর প্রতীক হিসেবে পূজিত হতে অসুবিধা কোথায়? তবে নিখুঁত প্রমাণ দিয়ে এই নিয়ে কিছু বলা যায় না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের ধারায় যখন যে ধর্ম দেশে প্রভাবশালী হয়েছে সেই ধর্মের ছাপ যে জগন্নাথের উপর পড়ে গেছে তা ভালোমতই বোঝা যায় উপরের আলোচনা থেকে। এক মুসলমান সাধকের জগন্নাথ ভক্তির কথাও জানা যায়, তাঁর বাড়ির সামনে আজও দাঁড়ায় জগন্নাথের রথ। সুতরাং আলাদা করে তাঁকে শবর, বৌদ্ধ বা হিন্দুদের দেবতা না বলে ‘জগতের নাথ’ অর্থাৎ সকলের দেবতা বলাতেই বোধ হয় লুকিয়ে রয়েছে আসল রহস্যের সুলুক সন্ধানl
কণ্ঠ: শৌণক সান্যাল