Skip to content

Fourth Pillar | বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, উল্টোদিকে মোদি-শাহের গেমপ্ল্যানটা কী?

Fourth Pillar | বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, উল্টোদিকে মোদি-শাহের গেমপ্ল্যানটা কী?

Fourth Pillar | বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, উল্টোদিকে মোদি-শাহের গেমপ্ল্যানটা কী?   

গতকাল বলেছিলাম বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন মূলত ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স-এর হানার বিরুদ্ধে, যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কাঠামো ফেরানোর বা কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে, রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালদের অগণতান্ত্রিক কাজের বিরুদ্ধে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের, দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টার বিরুদ্ধে। কিন্তু সমস্যা হল এই বিষয়গুলো নিয়ে বিরোধীরা মানুষের কাছে গেলে, এর বেশিরভাগটাই মানুষের মাথার ওপর দিয়ে যাবে। অন্যদিকে আম জনতার প্রতিদিনের যে সমস্যা, কৃষকের, শ্রমিকের, বেকারের, ছাত্রের যে সমস্যা তা নিয়ে এখনও বিরোধীরা রাস্তায় নেই। আপাতত কেবল পদযাত্রা, বিভিন্ন বৈঠকের, আলোচনার মধ্যেই আটকে আছেন। পদযাত্রা করে রাহুলের রাজনৈতিক উচ্চতা বেড়েছে? হ্যাঁ বেড়েছে বইকী। নীতীশ-মমতা-অখিলেশ-রাহুল-সোনিয়া-খাড়্গে-কেজরিওয়াল-স্তালিন-উদ্ধব বৈঠক হয়েছে, কিন্তু মানুষের সমস্যা নিয়ে রাস্তায়? না, সে কাজ এখনও শুরুই হয়নি। অথচ কাগজে কলমে ২০২৪-এর নির্বাচনের কিন্তু একবছরও বাকি নেই। বিরোধীরা ভাবছেন, কর্নাটকে বিজেপি হারবে ব্যস, তারপর তো এমনি এমনিই ধসে যাবে আরএসএস–বিজেপির কেল্লা। কিনোখ্যাপা বলে গিয়েছেন সেই কবে, ভাবো ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো। বিরোধীরা ভাবা প্রাকটিস করছেন, করেই চলেছেন। উল্টোদিকে আরএসএস–বিজেপি? 

দফতরে গিয়ে দেখুন সম্ভবত ২০২৯-এর নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এক বিশাল নির্বাচনী যন্ত্র, কেবল মাত্র তথ্য জোগাড় এবং অ্যানালিসিস করার জন্য যে ব্যবস্থা তা দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। সোশ্যাল মিডিয়া প্রচার বিভাগ, তার পেনিট্রেশন দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। দেশে মানুষের মোবাইল আছে আর তার কাছে এই আইটি সেলের কোনও প্রচার পৌঁছয়নি, এটা অসম্ভব। রাজনৈতিক প্রচারের কথায় পরে আসব, আগে বোঝার চেষ্টা করুন এই প্রচার কীভাবে আপনার মুঠোফোনে, আপনার ড্রয়িং রুমে এসে হাজির হচ্ছে। একটা ঘটনা চাই, মুহূর্তের মধ্যে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে এই প্রচার যন্ত্রের। বাচ্চারা স্কুলে যাবে, ইতিহাস বদলে দেওয়া হচ্ছে, সেদিন সতপাল মালিক বলছিলেন, এর আগে ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপারের মতো বিদ্বজনেরা বলেছেন, শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে সিলেবাস কমিটি দখল করেছে আরএসএস–বিজেপির লোকজন। তাঁরা সিলেবাস পাল্টে দিচ্ছেন, স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল ইতিহাস বাদ, সেকেন্ডারিতে ডারউইন বাদ। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, সেখানে হিন্দু বিল্ডিং স্ট্রাকচার পড়ানো হচ্ছে, তার মধ্যেই এসে গেছে শ্রী রামচন্দ্রের সেতুবন্ধন, সেটাই নাকি হিন্দু স্থাপত্য। মেডিক্যাল সায়েন্সে চরককে কেবল আনা হয়েছে তাই নয়, হিপোক্রাটিস ওথকে সরিয়ে এখন চরক প্রতিজ্ঞা চালু হচ্ছে। 

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | মোদি-শাহের নজরদারি, অঘোষিত জরুরি অবস্থা   

দেশের প্রত্যেক বিরোধী-কণ্ঠ, প্রত্যেক প্রতিবাদী স্বরের ওপর নজরদারি চলছে, একটু বেগড়বাই দেখলেই ইডি সিবিআই। সে বিবিসিই হোক কিংবা অক্সফ্যাম, ছাড় নেই। ওটিটি বা এন্টারটেনমেন্ট চ্যানেলে যা ইচ্ছে দেখান, যা ইচ্ছে, সফট পর্ন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদ, ভুল বিকৃত ইতিহাস থেকে গুরুজি বাবাজিদের ঘৃণা ভাষণ, হেট স্পিচ। কেউ আটকাবে না। এখন নজরদারি চলছে নিউজ মিডিয়ার উপরে। দেশের প্রত্যেক আমলা, প্রশাসন, বিচার বিভাগের মাথায় বসে থাকা মানুষজন ইজ আন্ডার সার্ভেইলান্স, বিগ বস ইজ ওয়াচিং ইউ। কাজেই ফলও হাতেনাতে বলার আগেই, আদেশ দেওয়ার আগেই মাথা নত হয়ে আছে তাদের গরিষ্ঠাংশের। যাঁদের বিদ্বজন বলে ভাবতাম, যাঁদের ভাবনাচিন্তার ওপরে আমাদের আস্থা ছিল, তাঁরা একে একে হয় গর্তে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন, নাহলে মাথা নোয়াচ্ছেন। এই তো সেদিন এই বাংলায় কোট আনকোট প্রতিবাদী চেহারা, জীবনমুখী গানের তিন শিল্পীর গান শুনলেন শুভেন্দু অধিকারী সমেত বিজেপি রাজ্য নেতারা, মঞ্চে গান গাইছেন শিলাজিৎ, রাঘব, রূপঙ্কর। হ্যাঁ, বিজেপির বর্ষবরণ, আয়োজক রুদ্রনীল ঘোষ। আগামী নির্বাচনের এদের যে কাউকে দেখা যেতেই পারে প্রচারে, কিংবা প্রার্থী হিসেবে। এটাই আরএসএস–বিজেপির প্রস্তুতিপর্ব। হ্যাঁ, একটা নির্দিষ্ট নির্বাচন নয়, ফ্যাসিজম তার চেয়ে অনেক বড় লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামে, নেমেছে। আরও তৃণমূল স্তরে গ্রামে গ্রামে চণ্ডীমণ্ডপ দখল করেছে আরএসএস প্রচারকরা, আপাত নিরীহ অহোরাত্র কীর্তন হচ্ছে, তার আড়ালে। একটা ঘটনা ঘটলে এঁরাই দিশা নির্দেশ করছেন, ঘৃণার পুঁটলি খুলে দিচ্ছেন। যে গ্রামে অনায়াসে এক মুসলমান পথিক বাড়ির সামনে এসে জল চাইলে জলের সঙ্গে গুড়-বাতাসা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, সেখানে এখন সন্দেহের বিষ। যে কোনও মুহূর্তে সেখানে গরু চুরির অভিযোগে তাকে পিটিয়ে মারা হতে পারে, কৈশোর প্রেম, বাড়ির অভিভাবকদের মানা এবং আত্মহত্যার চেষ্টা অনায়াসে লাভ জেহাদে পরিণত হচ্ছে, যদি ঘটনাচক্রে মেয়েটি হিন্দু আর ছেলেটি মুসলমান হয়। শহর, গ্রাম, মফস্‌সল প্রত্যেক এলাকায় একই ঘৃণা আর সন্দেহ ছড়িয়ে গেছে যা আমরা গত ১৫-২০ বছর আগেও টের পাইনি। 

এরকম এক আবহই তো বিজেপির নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট, এই আবহে বিজেপি বিরোধীদের শতহস্ত পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে। হাতের প্রথম অস্ত্র উগ্র হিন্দুত্ববাদ। চলতে থাকা প্রচারের মধ্যেই দুটো ইভেন্ট সামনে আসছে, ২০২৪-এর আগেই দেখতে পাবেন। যদি কর্নাটকে বিজেপি হারে তাহলে এ বছরেই আসবে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা। তৈরি থাকুন, কেন কোট আনকোট ওদের জন্য আলাদা আইন থাকবে? মাথায় রাখুন ওদের জন্য, এই ওদেরটা কারা? বুঝিয়ে বলতে হবে না। বলা হচ্ছে দেশের প্রত্যেক মানুষের জন্য একই আইন হোক। এই যুক্তি নিয়েই আদতে মুসলিম পারসোনাল কোড বাতিল করার দাবিতে নামবেই বিজেপি, গোটা দেশে আগুন লাগবে? লাগুক। সেই আগুনে মেরুকরণ বাড়বে। মানুষ ভুলেই যাবে যে হিন্দু পারসোনাল কোডও আছে, আছে পারসি, শিখদের পারসোনাল কোড। কেন ওদের থাকবে? সেটাই প্রশ্ন। পাড়ায় পাড়ায় এই কথাই শুনবেন। দ্বিতীয় ইভেন্ট অযোধ্যায় রাম মন্দির। সারা দেশ মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের আবেগে ভাসবে। হ্যাঁ, সামনের মুখ নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি আর আদিত্যনাথ যোগী। দেশ তো হিন্দুদের, তাহলে কেন হিন্দুরাষ্ট্র হবে না? আপনার পাড়াতেই বসে শুনবেন। এরসঙ্গে তাদের তূণীরের পরের অস্ত্র জঙ্গি জাতীয়তাবাদ। আবার হামলা করতে দেওয়া হবে, সব জানার পর কিছু বোড়ের মৃত্যু, এবং সেই মৃত্যুকে ঘিরে আবার পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান, ঘর মে ঘুসকর মারেঙ্গে, একটা ছোটখাটো যুদ্ধ, ইদানিং যাকে বলা হয় লো ইনটেন্সিটি ওয়ার হতেই পারে। আমরা তো জানি, যখনই প্রশ্ন ওঠে বস্ত্র কি খাদ্য, সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য। বেকারত্ব গত ৪০ বছরের রেকর্ড সীমায়, চলে যাবে পিছনে, কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না, উবে যাবে এ দাবি, শ্রমিকদের মাইনে বাড়ছে না, কেউ শুনবে না। অবাধ লুঠ চলছে আম্বানি আদানি কর্পোরেটদের, এ কথা নিয়ে কোনও আলোচনাই হবে না। দেশ তখন শত্রুকে চিনে ফেলেছে, ১৯৩৩ থেকে জার্মানির মানুষ যেমনটা বুঝেছিলেন, দেশের প্রত্যেকটা সমস্যার জন্য দায়ী ওই ইহুদিরা, তারাই নাকি উইপোকার মতো সব শেষ করে দিচ্ছে, অতএব ইহুদি হাটাও। আজ আমাদের দেশে সে আঙুল দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের বিরুদ্ধে। 
এটাই বিজেপির অস্ত্র। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিরোধী শিবিরের মুখগুলোর সঙ্গে দুর্নীতির মাখামাখি চেহারা, সেও এক কদর্য ছবি। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, গয়না আর সম্পত্তির দলিল বলে দিচ্ছে দুর্নীতির কালো শেকড়ের গল্প। যেদিকে তাকান, এক লুঠ, কাটমানি, দুর্নীতির ছবি। বিজেপি কেবল টর্চ মেরে আলো ফেলে কেবল বিজেপি বিরোধীদের দুর্নীতি সামনে আনছে, বিজেপির সঙ্গে থাকলে, বিজেপিতে যোগ দিলে সে দুর্নীতির গায়ে মোটা আবরণ, তাকে দেখা যাচ্ছে না। এটা সত্যি, কিন্তু বিরোধী ওই নেতাদের দুর্নীতিটাও তো সত্যিই, আর মানুষ সেটা দেখছে, মাত্র ১০ বছরের মন্ত্রিত্ব পেয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে কত সম্পদ জমেছিল। এই হাতিয়ার সামনে রেখেই বিজেপির প্রচার, সব দুর্নীতিবাজেরা মোদিজির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মোদিজি আঙুল তুলে বলবেন, মিত্রোঁ কারাপটেড মেন আর ইউনাইটেড। মানুষের অবিশ্বাস করার কারণটা বলুন? এইখানেই অ্যাডভানটেজ বিজেপি। গত ৯ বছরে মোদি সরকার দেশের মানুষের কোনও সমস্যার সুরাহা করতে পারেনি, তথ্য বলছে, মানুষের অভিজ্ঞতা বলছে সেই কথা। কিন্তু তাদের প্রচারে তারা এগিয়ে, ক্ষমতার প্রতিটা বিন্দুকে কাজে লাগিয়ে তারা দেশের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান নিজেদের দখলে আনতে পেরেছে। অবাস্তব, অনৈতিহাসিক, অবৈজ্ঞানিক তথ্য মানুষের সামনে পৌঁছে দিতে পেরেছে, এইখানেই অ্যাডভানটেজ বিজেপি।

তাহলে? আপনি ভাবতেই পারেন, তাহলে করবটা কী? হ্যাঁ, লড়াই শক্ত, বিরোধীদের লড়াই আরও শক্ত। আর লড়াই যখন শক্ত হয়, তখন একটাই উত্তর— পথে নামুন, মানুষের কাছে যান, সত্যি কথাটা বলুন, বলতে থাকুন। আপাত হিন্দুত্ব আবেগে ভাসছে দেশ, জঙ্গি জাতীয়তাবাদের আবেগে ভাসছে দেশ। কিন্তু মানুষের পেট মানুষের মাথাকে চালনা করে, কেবল আবেগে পেট ভরে না, সেই আবেগের উপরেও থাকে মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই। সে প্রশ্ন সামনে আসতে বাধ্য, আজ, নয়তো কাল, মানুষ বলবেই, অন্ন দাও, বস্ত্র দাও, মাথার ওপর ছাদ চাই, বেকার যুবকের চাকরি চাই, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা চাই। আর এই দাবির পেছনেই ঢাকা পড়বে যাবতীয় আবেগ। মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম থাকবেন বাড়িতে, বাড়ির বাইরে লড়াই হবে ভাতের। স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিস্টরা এই লড়াইতেই হেরেছে বার বার, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।      

 

বার্তা সূত্র