Skip to content

স্মরণে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম : ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফাঁসির মঞ্চেও বিজয়ের গান গেয়েছেন

ক্ষুদিরাম বসু ছিলেন একজন তরুণ বাঙালি বিপ্লবী । যিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর প্রত্যয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞানে ফাঁসির মঞ্চেও বিজয়ের গান গেয়েছেন।

দেশের সর্বকনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি বরণ করে নিয়েছিলেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু। ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট মুজফফরপুর ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসি হয় এই মহান বিপ্লবীর, তখন খাতায় কলমে তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর, ৭ মাস, ১১ দিন। তারুণ্যের শুরুতেই যে প্রাণকে ঝরে যেতে হল, তাঁর শরীরের মৃত্যু হলেও অমর হয়ে থেকে গেলেন প্রতিটি ভারতবাসীর মনের মণিকোঠায়।

বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকিকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদিরাম বসু বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কারণ, যুগান্তর পত্রিকার ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অন্যান্য সম্পাদকদের কঠোর সাজা দিয়েছিলেন কিংসফোর্ড। সেই মামলার বিরুদ্ধে প্রচার করায় একজন বিপ্লবী সুশীল সেনকে চাবুক মারার সাজা দেন কিংসফোর্ড । বিপ্লবীদের কাছে নিষ্ঠুর বিচারক হিসেবে কুখ্যাতি ছিল ডগলাস কিংসফোর্ডের। আলিপুর প্রেসিডেন্সি আদালতে মুখ্য হাকিম হিসেবে কাজে যোগ দেওয়ার সময় থেকেই নবীন রাজনৈতিক কর্মীদের কঠোর ও নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করতেন। তিনি ওইসব কর্মীদের শারীরিক নির্যাতনের সাজা দিতেন।

পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল মুজফ্ফরপুরের ইউরোপীয়ান ক্লাবের সামনে, একটি গাড়িতে ওই বৃটিশ বিচারক সওয়ার রয়েছেন ভেবে গাড়িটি লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু হিসেবের গরমিলে এই প্রয়াস ব্যর্থ হয় দুই বিপ্লবীর। কারণ যে গাড়িটি লক্ষ্য করে তাঁরা বোমা ছোঁড়েন তাতে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড ছিলেন না, তিনি পিছনের গাড়িতে ছিলেন। একইরকম দেখতে দুটি গাড়ির প্রথমটিতে ছিলেন দুই বৃটিশ মহিলা মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যা। গাড়িতে বোমা এসে পড়লে মিস কেনেডি তৎক্ষণাৎ মারা যান। মিসেস কেনেডি মারা যান ২ মে।
ঘটনার পরেই প্রফুল্ল চাকি গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় ছিলেন। তাঁর কাছে মাত্র একটিই গুলি অবশিষ্ট ছিল। ফলে নিজের মুখে গুলি করে আত্মহত্যা করেন প্রফুল্ল চাকি। কিন্তু বৃটিশ পুলিশের হাতে ওয়াইনি স্টেশনে গ্রেফতার হন ক্ষুদিরাম বসু। ওয়াইনি রেল স্টেশনটির নাম বদল করে বর্তমানে নাম হয়েছে ক্ষুদিরাম বোস পুসা স্টেশন।

গ্রেফতারের সময় তাঁর কাছ থেকে ৩৭ রাউন্ড গোলাগুলি, ৩০ টাকা নগদ, একটা রেলপথের মানচিত্র এবং একপাতা রেলের সময়সারণি উদ্ধার করে পুলিশ।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম বসুকে ফাঁসি দেওয়া হয় মুজফফপুর সংশোধনাগারে। বর্তমানে সেই কারাগারের নামও বদলে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর নামেই নামকরণ করা হয়েছে।

ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুর শহরের কাছাকাছি (বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) কেশপুর থানার অন্তর্গত মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার। তাঁর মায়ের নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। তিন মেয়ের পর মায়ের চতুর্থ সন্তান ক্ষুদিরাম। আরো দুই পুত্রসন্তানের শিশুকালেই মৃত্যু হয়, তাই ছোট ছেলের মৃত্যুর আশঙ্কায় লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে তাঁর বড়ো দিদির কাছে তিন মুঠো ক্ষুদকুঁড়োর বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া। মৃত্যুভয় তাঁর নেই। ক্ষুদের (চালের ভাঙা টুকরো) বিনিময়ে কেনা হয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে ক্ষুদিরাম নাম রাখা হয় তাঁর।

ফাঁসির মঞ্চে শেষ কথা কী বলেছিলেন শহিদ ক্ষুদিরাম? কী ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা?

১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির মঞ্চে, বাংলা তথা ভারত হারিয়েছিল এক আদ্যন্ত নির্ভীক সন্তান ক্ষুদিরাম বসুকে। স্বাধীনতার স্বপ্নে যিনি মৃত্যু ভয়কেও বশ করেছিলেন। এমনকী, ফাঁসির মঞ্চে তাঁর শেষ কথাও চমকে দিয়েছিল উপস্থিত সকলকে।

বিচারে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন বৃটিশ বিচারক মি. কর্নডফ। রায় ঘোষণার পর ক্ষুদিরামের মুখে ছিল হাসি। অল্প বয়সী ক্ষুদিরামকে বিচারক কর্নডফ প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফাঁসিতে যে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে তো?

স্বাধীনতার আকাঙ্খায় এমনই নির্ভীক ছিলেন মেদিনীপুরের এই বিস্ময় যুবক। রায় ঘোষণার পর জীবনের শেষ কযেকটা দিনে কারাগারে বসে মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে চেয়েছিলেন। ১০ আগস্ট আইনজীবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীকে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, ‘রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহরব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।’

আর ফাঁসির আগে ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা কী ছিল জানেন? সেইসময়ও দেশের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করে গিয়েছেন তিনি। বলেছিলেন, তিনি বোমা বানাতে জানেন। সুযোগ পেলে সেই বিদ্যা তিনি ভারতের যুবকদের শিখিয়ে যেতে চান।

তবে ফাঁসির মঞ্চে এসেও যে প্রশান্তি ছিল তাঁর মনে, তা সবচেয়ে বিস্ময়কর। ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। দুই দিকে ছিল দুটি খুঁটি। তার উপর একটি মোটা লোহার রড ছিল আড়াআড়িভাবে লাগানো। সেই রডের মাঝখানে মোটা একগাছি দড়ি বাঁধা ছিল। তার শেষ প্রান্তে ছিল মরণ-ফাঁস।

ক্ষুদিরামকে সেই মঞ্চে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন বৃটিশ সরকারের চারজন পুলিশ। ক্ষুদিরাম ছিলেন তাঁদের সামনে। ফাঁসির আগে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর পিছমোড়া করে বাঁধা হয় দুইহাত। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্র জল্লাদকে শহীদ ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন ‘“ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?” এটাই ছিল বীর শহিদের জীবনের শেষ কথা। জল্লাদ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারেননি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন বৃটিশ জেলর থেকে উপস্থিত সকলে। ফাঁসির আগে কী করে কারোর মনে এই প্রশ্ন আসতে পারে?

মৃত্যুর ১১৩ বছর পরেও তাই সেই নির্ভীক কিশোর স্বাধীন ভারতের মানুষের মনে অমর হয়ে আছেন।
[কৃতজ্ঞতা : এনডিটিভি, এশিয়ানেট নিউজ]