Skip to content

সম্প্রদায়গত পরিচয় যদি হয় ন্যায়বিচারে বাধা

আমাদের জাতীয়
ইতিহাসে অবশ্যই ৭ মার্চ বাঁক পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিন, একই সঙ্গে প্রেরণা জাগানিয়া
অধ্যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বারবার আশাবাদ ব্যক্ত করছেন,
বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আরও বেশি শানিত হয়ে অধিকতর শক্তি নিয়ে জেগে উঠবে।
তাদের এ প্রত্যাশা অমূলক নয়, এর সাক্ষ্য বায়ান্ন বছরের বাংলাদেশে বহুবারই মিলেছে। যুদ্ধাপরাধ
বিচারের ক্ষেত্রে তারুণ্যের জাগরণ আশা ও স্বপ্নের জমিনে যে বীজ বপন করেছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে
মহান মুক্তিযুদ্ধ, এ মানচিত্র অর্জনের জন্য সংঘটিত জনযুদ্ধের গর্বিত অংশীজন বীর মুক্তিযোদ্ধারা
বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তা মোটেও অমূলক কিছু নয়। জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ
সুস্পষ্ট করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ঠিকানা দিয়েছিলেন। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে
অর্জিত রক্তস্নাত বাংলাদেশে অনেক অঙ্গীকার-প্রত্যয় এখনও রয়ে গেছে অবাস্তবায়িত।




স্মরণ করছি লিও
তলস্তয় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সেই কবে সমাজ, রাজনীতি, মানুষের জীবনাচার নিয়ে অনেক
গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে গিয়ে খ্যাতিমান সাহিত্যিক লিও তলস্তয় বলেছিলেন, ‘একটি দেশ ধ্বংস
করতে হলে সে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মের লড়াই লাগিয়ে দিলেই চলবে।’ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
বলেছিলেন, ‘ধর্মের দেশে মোহ যারে এসে ধরে/অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মারে।’ তাদের কথাগুলো
আজও খুব প্রাসঙ্গিক। কেন প্রাসঙ্গিক? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল অঙ্গীকার ছিল অসাম্প্রদায়িক
ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু এর কোনোটিই এখনও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রদায়িকতা
এখনও বিষবাষ্প ছড়ায় আর বৈষম্য ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে; যা শুধু অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেই
নয়, সামাজিক বিভিন্ন কাঠামোয়ও এর ছায়া প্রলম্বিত। সাম্প্রদায়িকতা গুরুতর ব্যাধি এবং
স্বাধীন বাংলাদেশ এখনও এ ব্যাধিমুক্ত হতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দায়ী প্রগতিশীল
রাজনীতিকদের ব্যর্থতা। গত বছর এ মার্চেই পঞ্চগড়ে আহ্‌মদীয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক একটি
অনুষ্ঠানে সহিংস হামলায় হতাহতের মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছিল। বিচার সম্পন্ন হয়েছে বলে
কিনা জানিনা। বিগত দিনে দেশে যত সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে তার সিংহভাগই গুজবকেন্দ্রিক
এবং পঞ্চগড়ের ঘটনাটি এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। আমাদের দেশে পোলিও, গুটিবসন্ত ইত্যাদি
নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধির উপশম ঘটলেও সাম্প্রদায়িকতা নামক ব্যাধির উপশম স্বাধীনতার
পাঁচ দশক পরও হয়নি।



মার্চ আমাদের
জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ মার্চেই তো বাঙালি জাতি স্বাধীন ভূখণ্ডের ও মানবিক
চেতনার যে দেশের স্বপ্ন লালন করে আসছিল এর বাস্তবায়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের নির্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বিশ্ব ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায় একাত্তর
পর্ব আমাদের বাঁক পরিবর্তনের নিশানা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার সাম্প্রদায়িকতার
নিরসন। তা হয়েও ছিল। রক্তগঙ্গা পেরিয়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় সে দেশে একাত্তরে মাটিচাপা
দেওয়া সাম্প্রদায়িকতার ভূত আবার অপচ্ছায়া ফেলবে, তা ছিল অচিন্তনীয়। পঁচাত্তরের রাষ্ট্রীয়
সন্ত্রাসের হোতারা সপরিবার শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই হত্যা করেনি;
হত্যা করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও।



সংখ্যাগরিষ্ঠ
মানুষের সব প্রত্যাশা-স্বপ্ন পদপিষ্ট করে তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তি দেশকে নিয়ে যেতে শুরু
করে পেছনের দিকে। ওই অন্ধকারাচ্ছন্ন, জীবনবৈরী পরিস্থিতির নিরসন ঘটিয়ে ফের শুরু হলো
সম্মুখযাত্রা। তার পরও অপচ্ছায়া পিছু ছাড়েনি। নতুন প্রত্যাশা-স্বপ্ন যদিও সাধারণ মানুষের
চেতনায় লালিত ছিল, কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির মেরুকরণের সমীকরণে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা
পায়নি আজও। অন্ধকার রয়েই গেল। রাজনীতির মেরুকরণের সমীকরণে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বিভাজন
আরও প্রকট হয়ে উঠতে থাকল। এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই।
কিন্তু আমাদের রাজনীতির ধরনটা হলো, পদে পদে মনে করিয়ে দেওয়া হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরবিরোধী
দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠী। মানবিক চেতনার মানুষের জন্য এমনটি অকল্যাণ ডেকে আনল। ব্রিটিশের
তৈরি ভ্রান্ত ইতিহাস আমরা নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়েছি, পদে পদে তাকে ঘাড়ে বয়ে চলেছি। কে
জানত স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও ওই ভ্রান্ত চেতনা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না!



সাম্প্রদায়িকতা
নয়, চাই মানবিক বাংলাদেশÑএ স্লোগান প্রগতিবাদী নানা মহলের তরফে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে,
এখনও হচ্ছে। কিন্তু তা যেন স্বপ্নের বৃত্তবন্দি। ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশসহ
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ক্রমবর্ধমান ও চিহ্নিত সমস্যা। সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, বৈষম্য,
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন এমনকি স্বধর্মের অন্তঃকোন্দল এবং জঙ্গিবাদ
ও ধর্মীয় উগ্রবাদ ইত্যাদি সম্পৃক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান নিয়ে
কিছু বলতে গেলে ইতিহাসের পাঠ নিতে হয়। আহ্‌মদীয়া-শিয়া-সুন্নি সবাই ইসলামের অনুসারী
হলেও সম্প্রদায়গত বিভাজনের দেয়াল রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ সম্প্রদায়-বিভাজন সামাজিক
স্থিতিশীলতা ও ধর্মীয় সহাবস্থানের জন্য শুধু প্রতিকূলই নয়, একে কেন্দ্র করে ক্ষতের
ওপর ক্ষত সৃষ্ট হওয়ার বহু নজিরও স্বাধীন বাংলাদেশেই রয়েছে।



সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি রক্ষায় শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, সামাজিক শক্তিও কতটা গুরুত্বপূর্ণ, নতুন
করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা,
সামাজিক ন্যায়বিচারের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছিল এবং সংবিধানে তা লিপিবদ্ধও হয়েছিল;
এরও সুরক্ষা দেওয়া যায়নি রাজনৈতিক হীনস্বার্থের কারণেই। বাহাত্তরের সংবিধানে সব ধরনের
সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে মর্যাদাদান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের
অপব্যবহার, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য ও নির্যাতন রুখে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। কিন্তু
সে অঙ্গীকার মলাটবদ্ধই রইল।



সাম্প্রদায়িকতা
ও অপরবিদ্বেষের বিরূপ ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এর বহু নজির আছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের
পূর্বাপর ইতিহাসে। গত কয়েক বছরে নানা অজুহাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার
যে হিংস্র উন্মাদনা লক্ষ করা গেছে, তাতে সঙ্গতই ফিরে ফিরে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছেÑএই কি আমাদের
সেই বাংলাদেশ? আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ কিংবা ভারতে সাম্প্রদায়িক কোনো ঘটনা ঘটলে দুই
দেশেই শুরু হয় বিদ্বেষী অপসংস্কৃতির চাষ। এসবই ক্রমে ডালপালা মেলে এবং সমাজের ভেতর
ঘাপটি মেরে থাকে। এর ওপর ভর করেই প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্ম-বর্ণান্ধ রাজনীতি, দখল-লুণ্ঠনের
অর্থনীতি বেড়ে ওঠে। আমরা এও দেখেছি, যারা এসবের সুবিধাভোগী, তারা এ বিদ্বেষ চাষে খুব
তৎপর থাকে। মনে রাখা জরুরি, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিনির্মাণ হয়েছে অসাম্প্রদায়িক
জাতিসত্তার শক্তিতে এবং এ শক্তিই আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। কিন্তু সেই ভিত্তিতে
ফাটল ধরানোর চেষ্টা সেই পঁচাত্তরে শুরু, এখনও তা নানা কৌশলে চলছে।



নাগরিক অধিকারের
অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ রয়েছে। এর মধ্যে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও অধিকার অন্যতম।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আইনবহির্ভূত কারণে এ দেশে বিপন্ন বোধ করে এমন মানুষের
সংখ্যা অসংখ্য। পঞ্চগড়ে যে ঘটনাটি ঘটেছিল এর প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রশক্তির তরফে অতীতের
মতোই বারবার শোনা গেছে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক
ক্ষেত্রেই দেখা গেছে রাজনৈতিক ও সম্প্রদায়গত পরিচয় ন্যায়বিচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে
এবং বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি পুনরায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পথ আরও প্রশস্ত করে দিয়েছে।
সমাজে সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরির দায়টা যেমন রাষ্ট্রশক্তির ও রাজনৈতিক দলের; তেমন সামাজিক
শক্তির ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা দেখছি, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে
দিতে কারা বারবার কলকাঠি নেড়েছে? একজন নাগরিক শুধু ধর্মীয় কিংবা সম্প্রদায়গত পরিচয়ের
কারণে আক্রান্ত হবেন, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?



দুই বছর আগে ঢাকায়
এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি
নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। কারণ আমরা বাহাত্তরের মূল সংবিধান ফিরে পেতে চাই। কখন, কীভাবে
কোন বাস্তবতার নিরিখে এটা করা হবে তা দল ও সরকার নির্ধারণ করবে।’



ঐতিহাসিক এ মার্চে
আমরা যখন নানা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বারবার অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে উচ্চারণ
করছি; এ প্রেক্ষাপটে ফের সে প্রশ্নটিই সামনে আসে- বাহাত্তরের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু জাতির
যে রক্ষাকবচগুলো সংযুক্ত করে একটি অনন্যসাধারণ মুক্তির দলিল রচনা করেছিলেন, এর সেই
অবয়ব পূর্ণমাত্রায় ফিরে আসবে কবে? বর্তমান প্রজন্ম বিশ্বাস করে, বাহাত্তরের সংবিধানের
পুনরুজ্জীবনই অন্ধকার ঘোচানোর বড় সহায়ক শক্তি।

  • সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক



বার্তা সূত্র