পুলক ঘটক, বেনার নিউজ: বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ মানুষ দুর্নীতিকে একটি বড়ো সমস্যা হিসেবে মনে করেন বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) নতুন এক জরিপ। একই চিত্র এশিয়ার অনেক দেশেরই। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব বলে মনে করেন এশিয়ার মানুষ।
টিআইয়ের গবেষণায় অংশ নেওয়া পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ঘুষের পাশাপাশি ‘যৌনঘুষ’ প্রদানের অভিজ্ঞতার কথাও বলেছেন।
মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, চীন ও ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ১৭টি দেশে নাগরিকদের ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য জানতে চাইলে মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “সরকারের দুর্নীতি বিরোধী জিরো টলারেন্স নীতির কারণে বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে।”
“দুর্নীতির আভিযোগ পেলে আমাদের সরকার কাউকেই ছাড় দেয় না; এমনকি আমাদের দলের হলেও না। সরকারি কর্মকর্তা এবং সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধেও দুদক স্বাধীনভাবে তদন্ত করছে—এটা আপনারা দেখেছেন,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, সরকারি সেবা ডিজিটাল হওয়ার ফলে স্বচ্ছতা বেড়েছে, সবকিছু ডিজিটাল হলে দুর্নীতি আরও কমবে।
তবে মঙ্গলবার প্রকাশিত টিআইর প্রতিবেদনটি এখনো তিনি দেখেননি বলে জানান আইনমন্ত্রী।
বাংলাদেশ, চীন ও ভারত ছাড়া টিআইর জরিপে অন্তর্ভুক্ত বাকি ১৪টি দেশ হলো, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, নেপাল, জাপান, ফিলিপাইন ও দক্ষিণ কোরিয়া।
‘পরিবর্তন সম্ভব’
টিআই জরিপে অংশ নেওয়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর তিন চতুর্থাংশ নাগরিক সরকারি দুর্নীতিকে একটি বড়ো সমস্যা বলে মনে করেন। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিবর্তন আনা সম্ভব বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন।
বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ওপর নজরদারি করা বার্লিনভিত্তিক টিআই’র প্রতিবেদন জানায়, বাংলাদেশসহ জরিপকৃত ১৫টি দেশের নাগরিকরা নির্বাচনে অর্থ লেনদেনের বাস্তবতা স্বীকার করেছেন।
এর মধ্যে থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ার সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ, ভারতের ১৮ শতাংশ ও বাংলাদেশের ৮ শতাংশ মানুষ তাঁদের দেশে ভোটের জন্য টাকা লেনদেনের কথা জানান।
এছাড়া জনসেবার জন্য ঘুষ বা সরকারি পরিষেবার জন্য ‘যৌন চাঁদা’ বিনিময়ের মুখোমুখি হওয়ার অভিযোগও করেছেন অনেকে।
‘গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-এশিয়া ২০২০’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে টিআই বলেছে, “দুর্নীতি বিরোধী প্রচেষ্টাকে টেকসই করতে এই অঞ্চলজুড়ে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং দুর্নীতকে প্রত্যাখ্যান করা নাগরিকদের জন্য জরুরি। এই লড়াই প্রায়ই ব্যক্তিপর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার মধ্য দিয়েই শুরু হয়।”
তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার ফলে প্রতিশোধের শিকার হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন সমীক্ষায় অংশ নেওয়া অনেক উত্তরদাতা।
“ভয়ের পরিবেশ এবং সীমিত বাকস্বাধীনতা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারে।”
জরিপে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ, ভারতের ৮৯ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ৯২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা নিজেদের দেশে সরকারি দুর্নীতিকে বড়ো সমস্যা বলে মনে করেন।
আন্দোলনের মাধ্যমে নাগরিকরা কোনো পরিবর্তন আনতে পারেন কিনা জানতে চাইলে, বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ, ভারতের ৫৬ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ায় ৫৯ শতাংশ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
“এই সাহসিকতা এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতের দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টার মূল চাবিকাঠি। এটি সংস্কারকামী সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজের হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
প্রসঙ্গ যৌনঘুষ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া—এই তিনটি দেশের নাগরিকরা সরকারি সেবা পেতে সর্বোচ্চ হারে ‘যৌন ঘুষ’ (অথবা যৌন চাঁদা) দেয়ার কথা বলেছেন।
ইন্দোনেশিয়ায় ১৮ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ১৫ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় ১২ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের চেনাজানার মধ্যে কেউ কেউ যৌন দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে এ রকম অভিযোগ ৯ শতাংশ মানুষের।
প্রতিবেদনে ইন্দোনেশিয়ার যৌন চাঁদাবাজির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলা হয়, মার্চ মাসে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত জাতীয় কমিশন জানিয়েছে যে, নারীদের প্রতি সহিংসতার প্রায় সব ঘটনা তদন্ত-পূর্ব পর্যায়েই শেষ হয়ে যায়। কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে থাকে।
“কিছু ক্ষেত্রে, প্রক্রিয়াটি লেনদেনমূলক, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষগুলো মামলা চালানোর জন্য অর্থ বা যৌনতা দাবি করে,” প্রতিবেদনে বলা হয়।
“আদালতে যৌন ঘুষ প্রমাণের অসুবিধা এবং নীরবতার সংস্কৃতি এ জাতীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড়ো বাধা এবং উদ্বেগজনক। ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানভুক্ত একমাত্র দেশ, যেখানে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধে জাতীয় বিধিবিধান নেই।”
‘ঘুষ জীবনের অংশ’
জরিপে অংশ নেয়া অনেক উত্তরদাতাদের কাছে ঘুষ দেওয়া ও নেওয়া জীবনেরই অংশ।
ভোটকে প্রভাবিত করার জন্য তাঁদের টাকা দেবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কিনা প্রশ্ন করা হলে ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের ২৮ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ২৬ শতাংশ ও বাংলাদেশের ৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ‘হ্যাঁ’ বলেন।
গত বছর তাঁরা কখনো সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিয়েছিল কিনা জানতে চাইলে, ইন্দোনেশিয়ার ৩০ শতাংশ, বাংলাদেশি ও থাইদের ২৪ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের ১৯ শতাংশ বলেছেন ‘হ্যাঁ’।
জরিপে পুলিশের পাশাপাশি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়েছে। এতে অংশ নেওয়া ২০ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুর্নীতিরোধে অনুকূল বলে মনে করেন।
উত্তরদাতাদের মধ্যে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী প্রয়ূথ চান-ও-চা’কে ৪৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে ২৫ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইদোদোকে ২০ শতাংশ উত্তরদাতা দুর্নীতি রোধে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের এই প্রতিবেদনকে এই অঞ্চলের ১৭টি দেশের ঘুষ সংক্রান্ত নাগরিক অভিজ্ঞতার সবচেয়ে ব্যাপক এবং বিস্তারিত জরিপ বলে দাবি করেছে।
২০১৯ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার মানুষ এই জরিপে অংশ নিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বেশিরভাগ সাক্ষাৎকার টেলিফোনে পরিচালিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
টিআই’র প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।