Skip to content

ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় আপত্তি নেই, ভিন্ন ধর্মে বিয়ে সমর্থন করেন না অধিকাংশ ভারতীয়

*লেবো ডিসেকো* বিবিসি বাংলা ঃ

এশা ও তার স্বামী রাহুলের সাথে কথা বললেই বোঝা যায় তারা নববিবাহিত দম্পতি। একজন আরেকজনের বাক্য পুরো করে দিচ্ছেন, এশার যখন মনে হচ্ছে রাহুল প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আরেক দিকে চলে যাচ্ছেন, তখন তিনি আবার কথাটাকে ঘুরিয়ে যে প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল সেদিকে নিয়ে আসেন।

তাদের বিয়ে যে সুখের হয়েছে – তার কারণ কী?

এশা আর রাহুল দুজনেই মনে করেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে তাদের ধর্মবিশ্বাসের অভিন্নতা – তারা দুজনেই হিন্দু । “স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একই ধর্মের হলে তা নানা দিক থেকে সহায়ক হয়” – বলছিলেন এশা, ” আামাদের খুব বেশি জিনিস নতুন করে শিখতে হয়নি। শুধু একে অপরকে বুঝতে হয়েছে, জানতে হয়েছে আমরা কে কি পছন্দ করি।”

পিউ রিসার্চ সেন্টার একটি জরিপ করেছে সারা ভারত জুড়ে – যার বিষয় হচ্ছে : ধর্ম।

এ জরিপে দেখা গেছে, ভারতীয়রা নিজেদের যেভাবে দেখেন, তার মধ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভারতের প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো বেশির ভাগই মনে করে তাদের মধ্যে খুব বেশি মিল নেই।

পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে ২০২০এর প্রথম দিক পর্যন্ত ভারতের ২৬টি রাজ্য এবং তিনটি টেরিটরিতে ১৭টি ভাষার প্রায় ৩০ হাজার লোকের সাক্ষাতকার নিয়েছে।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বেশির ভাগ হিন্দু, শিখ ও মুসলিমই বলছেন, ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করাটা তাদের ‘উচ্চ অগ্রাধিকার’ প্রাপ্ত বিষয়।

এমন ধারণা পোষণ করেন ৮০ শতাংশ মুসলিম এবং প্রায় ৬৫ শতাংশ হিন্দু।

আইনের সঙ্গে জরিপটিতে দেখা গেছে, ভারতের জনগণ একই সাথে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করছেন, আবার তার পাশাপাশি যার যার ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বিচ্ছিন্ন বৃত্তের মধ্যে রাখাকেই উত্তম মনে করছেন। বলা যায়, তারা একসাথেই বসবাস করছেন, কিন্তু পৃথকভাবে।

জরিপটিতে উপসংহার টানা হয় এইভাবে – এই দুই অনুভূতিকে বিপরীতধর্মী মনে হতে পারে কিন্তু বেশির ভাগ ভারতীয়ের জন্য ব্যাপারটি মোটেও তা নয়।

 ‘আমাদের অভিন্ন পটভূমি’

এশা এবং রাহুলের পরিচয় হয় অনলাইনে, এর পর তারা ৮ মাস প্রেম করার পর বিয়ে করেন।

করোনাভাইরাস মহামারির জন্য তাদের আড়ম্বরপূর্ণ ভারতীয় রীতির বিবাহের – যাকে এশা বলছেন, ‘বিগ ফ্যাট ইন্ডিয়ান ওয়েডিং’ – পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছিল, তবে গত বছর তাদের বিয়েটা হয়েছিল বাড়িতেই ছোট এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। তাতে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১১ জন নিকটাত্মীয়।

এশা বলছেন, তিনি যখন প্রথম একজন স্বামীর সন্ধান শুরু করেছিলেন, তখন তিনি বুঝতেই পারেননি যে অভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ব্যাপারটা কত গুরুত্বপূর্ণ।

“আমি ছিলাম একজন বিদ্রোহী, এবং মনে করতাম যে ধর্মবিশ্বাসের কোন গুরুত্বই নেই” বলছিলেন তিনি।

“কিন্তু যখন আমি একই ধর্মের একজন পুরুষকে বিয়ে করলাম – তখন দেখলাম এই মিল পুরো ব্যাপারটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। আর যদি আপনি একটি ভারতীয় যৌথ পরিবারে বাস করেন – তাহলে তো জীবন আরো সহজ হযে যায়।”

বৃহত্তর ভারতীয় সমাজেও এক ধর্মে বিয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে এই একই ধরনের মানসিকতার প্রতিফলন দেখা যায়।

রাহুল বলছেন, ভারতীয়রা পরিবার ও সম্প্রদায়ের প্রশ্নটি কীভাবে দেখে – তার সাথে এই এক-ধর্মে-বিয়ের সম্পর্ক আছে।

কোন একজন যদি ভিন্ন ধর্মের কাউকে বিয়ে করে তাহলে পরিবারের অন্যদের জীবনেও তার প্রভাব পড়ে।

সাংস্কৃতিকভাবে ভারতের মানুষ ‘একক’ বা ইন্ডিভিজুয়াল নয়, বলছিলেন রাহুল।

“খ্রিস্টান ধর্মে এবং আমেরিকার মত সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে মূল্য দেয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় পরিবারে আপনি সিদ্ধান্ত নেন যৌথভাবে।”

“এখানে আপনার সাথে একজন ব্যক্তির বিয়ে হচ্ছে না – বিয়েটা হচ্ছে দুটি পরিবারের মধ্যে।”

‘আপনাকে নিখুঁত হবার সন্ধানে থাকতে হবে না’

তানিয়া মালহোত্রা সোন্ধী হচ্ছেন একজন ঘটক। তিনি তার কাজের অভিজ্ঞতায় একই রকম মতের প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন। ঘটক তানিয়া বলছেন, তার মক্কেলদের কাছে ধর্মবিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ। “আমরা কাজ করি মুলত শহুরে জনগোষ্ঠীর মধ্যে – যারা প্রগতিশীল, শিক্ষিত, এবং পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন” – বলছিলেন তিনি।

“কিন্তু এর পরও অনেকেই নিজ ধর্মের বাইরের কাউকে বিয়ে করাকে সমর্থন করেন না।”

তানিয়া বলছেন, হয়তো এর সাথে এক ধর্মের লোকেরা আরেক ধর্মকে কিভাবে দেখে – তার একটা সম্পর্ক আছে।

তার কিছু হিন্দু মক্কেল উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে কোন মুসলিম বা খ্রিস্টানকে বিয়ে করলে তারা হয়তো ধর্মান্তর করাতে চাইবে।

তানিয়া একটি গল্প বললেন, যা তারই একজন মুসলিম পুরুষ মক্কেলের কাছ থেকে শোনা।

“সে আমাদেরকে বলেছে, হিন্দু নারীদের মধ্যে মুসলিমদের বিয়ে করার ব্যাপারে উদ্বেগ আছে। কারণ ইসলাম ধর্মে একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারে।”

“একজন মুসলিম পুরুষের যদি একটি মাত্র স্ত্রীও থাকে – তাহলেও যেহেতু তার ধর্মে এ সুযোগ আছে, সেকারণেই নারীদের মধ্যে এ উদ্বেগ”- বলছেন তানিয়া।

“তাদের ধর্মের মূল নীতিগুলোই আলাদা।”

কিন্তু তানিয়া এটাও বলছেন যে এসব দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তনও হয়ে থাকে।

“বিয়ের ক্ষেত্রে বলা যায়, যদি দু’জন মানুষের মনের মিল থাকে – তাহলে ধর্মের কোন বাধা হয়ে ওঠা উচিত নয়।”

এটা ছিল নিখাদ ভালোবাসা

এ কথার সাথে একমত সুমিত চৌহান ও তার স্ত্রী আজরা পারভিন।

সুমিত এসেছেন একটি হিন্দু পরিবার থেকে – যদিও তিনি বর্ণগতভাবে তার দলিত পরিচয়টিও দিয়ে থাকেন। তার স্ত্রী আজরা একজন মুসলিম। তাদের সাথে কথা হচ্ছিল তাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকীর পরদিন।

সুমিত ও আজরা বিয়ে করেছিলেন গোপনে

ছবির উৎস,SUMIT CHAUHAN & AZRA PARVEEN                                                                             সুমিত ও আজরা বিয়ে করেছিলেন গোপনে। সুমিতের সাথে আজরার পরিচয় হয় ২০১০ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের সম্পর্ক ক্রমেই আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।

“আমরা পরস্পরকে জেনেছি তিন বছর ধরে কলেজে পড়ার সময়। আমাদের বন্ধুত্ব ছিল খুব জোরালো। আমরা একে অপরের সাথে খুবই সুখী সময় কাটাতাম” – বলছেন সুমিত।

“তবে আমরা জানতাম আমাদের বিয়ে করাটা কঠিন হবে কারণ আমরা দু’জন দুই ধর্মের।”

সুমিত বলছেন, তার পরিবারে মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে কিছু ভুল ধারণা ছিল কিন্তু তার মা, ভাই ও বোনকে রাজী করাতে পেরেছিলেন।

“আমার স্ত্রী তার পরিবারকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা ছিল এর কড়া বিরোধী। তারা বলেছিল, আজরা কিছুতেই একজন হিন্দুকে বিয়ে করতে পারবে না।”

তাদের ধারণা হলো যে আজরার পরিবার এ বিয়েতে কখনোই রাজী হবে না।

ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন গোপনে বিয়ে করবেন, এবং তারপর তা পরিবারকে জানাবেন।

ভারতে স্পেশাল ম্যারেজ এ্যাক্ট বলে একটি আইন আছে – যার আওতায় ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষকে বিয়ের ৩০ দিন আগে প্রকাশ্যে বিবাহের ইচ্ছা ঘোষণা করতে হয়। এর অর্থ হচ্ছে, এ বিয়েতে কারো আপত্তি থাকলে তা জানানোর সুযোগ রয়েছে।

বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি যেসমস্ত রাজ্যে ক্ষমতাসীন রয়েছে – সেখানে আরো কিছু আইন করা হয়েছে।

সুমিত ও আজরা বলছেন, নিখাদ ভালোবাসার পরিণতিতেই তাদের বিয়ে

সুমিত ও আজরা পারভীন

এর একটি হচ্ছে বেআইনি ধর্মান্তর নিষিদ্ধকরণ অর্ডিন্যান্স। এটা উত্তর প্রদেশ রাজ্যে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে পাস হয়েছে। এতে জোর খাটিয়ে, জালিয়াতি করে বা বিয়ের মাধ্যমে “বেআইনি ধর্মান্তর” নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সুমিত বলছেন, “আমি একটু ভয়ে ছিলাম যে আমাদের বিয়ের পরিকল্পনা যদি ফাঁস হয়ে যায় তাহলে তা হয়তো থামিয়ে দেয়া হতে পারে।”

তাদের ভাগ্য ভালো যে সেরকম কিছু হয়নি।

কিন্তু তাদের বিয়ের তিন বছর পার হয়ে গেলেও আজরার পরিবারের সাথে মুখ দেখাদেখি ছিল না।

এখন অবশ্য তাদের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে। তবে আজরার পরিবার এখনো প্রকাশ্যে তাদের বিয়েকে স্বীকার করে না।

“গত বছর আমার স্ত্রীর ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু আমাদের দাওয়াত দেয়া হয়নি।”

সুমিত স্বীকার করেন যে তাদের মত দুই ধর্মের দুই ছেলে-মেয়ের জন্য প্রেম ও বিয়ে খুবই কঠিন ব্যাপার।

কিন্তু সুমিতের মতে “ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার জন্য কারো ধর্ম পরিবর্তন করার দরকার হওয়া উচিত নয়।”

“ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকাটা কোন অপরাধ নয়” – বলছেন তিনি। সূত্রঃ বিবিসি বাংলা