বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ও একজনের মৃত্যুসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম।
সিটির মোট ৭৩৫টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত একটা পর্যন্ত ঘোষিত ৬৯০টি কেন্দ্রের বেসরকারি ফলাফলে রেজাউল করিম পেয়েছেন তিন লাখ ৪২ হাজারের বেশি ভোট। অন্য দিকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মেয়র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন পেয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার ভোট।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে নগরীর এমএ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনাসিয়ামে স্থাপিত অস্থায়ী অফিস থেকে এই ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
সংঘাত, সহিংসতা, মৃত্যু
বুধবার নির্বাচন চলাকালে নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের আমবাগান এলাকার ইউসেফ স্কুল কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মো. আলাউদ্দিন আলো (২৮) নামে এক যুবক।
ওই যুবকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক বেনারকে জানান, ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ছয়জন।
“প্রাথমিকভাবে জেনেছি নিহত আলাউদ্দিন একজন নির্মাণ শ্রমিক। দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেছেন। পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে,” বলেন বিজয় বসাক।
আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাহমুদুর রহমান নিহত আলাউদ্দিনকে নিজের সমর্থক বলে দাবি করলেও নিহতের বোন জাহানারা বেগম স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমার ভাই সকালে নাশতা খাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। সে কারও পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট করার জন্য যায়নি।”
এছাড়া নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ২১ জন আহত হন। আসাদগঞ্জ সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র, জালালাবাদ, পাঠানটুলি, পশ্চিম বাকুলিয়া, ফিরিঙ্গিবাজার ও লালখান বাজার এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
সহিংসতার জন্য সরকারি দলকে দায়ী করে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী ডা. সাহাদত হোসেন চট্টগ্রামে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আমার প্রতিনিধি ও সমর্থকদের বের করে দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারি দলের পক্ষে পরিপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।”
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন কেন্দ্রে হামলা করেছে।”
বুধবার দুপুরে নগরীর বহদ্দারহাটের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে “নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তাঁর মতে, “এর ফলে সাধারণ মানুষ নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। ফলে মানুষ ভোট কেন্দ্রেই যাচ্ছে না।”
চট্টগ্রামের এই প্রাণহানি “নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য আরো একটি খারাপ উদাহরণ তৈরি করল,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যখন নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফেরানো দরকার, তখন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই বেশি দেখতে হচ্ছে।”
এর আগে চট্টগ্রামের এই নির্বাচনের প্রচারণাকালে সংঘর্ষে মারা গিয়েছিলেন আরও একজন। গত ১৩ জানুয়ারি পাঠানটুলি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল কাদেরের সমর্থকদের সংঘর্ষে ওই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম সিটি ছাড়াও দেশের পৌর নির্বাচনগুলোতেও সংঘর্ষ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর থেকে প্রথম দফায় ২৪টি এবং দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৫৬টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ওই নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় সারা দেশে অন্তত চারজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “বিরোধী দলকে দূরে রেখে আওয়ামী লীগ এখন নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। এতে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মানুষ ভোটাধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।”
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীর ৭৩৫টি কেন্দ্রে বুধবার সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়, চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
নির্বাচনে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের মধ্যে।
মেয়র ছাড়াও সিটির ৩৯ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ১৪ জন নারী কাউন্সিলর পদের জন্যও নির্বাচন হয়েছে বুধবার। এবার সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি।
ভোট গ্রহণ শেষে “চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ভালো নির্বাচন হয়েছে,” বলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সাংবাদিকদের জানান নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর।
তিনি বলেন, “তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নির্বাচনে সহিংসতার অনেক ঘটনা ঘটে। তবে চট্টগ্রামে কমই হয়েছে।”
“বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল,” দুপুরের দিকে টেলিফোনে বেনারকে বলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) এস এম মোস্তাক আহমেদ।