Skip to content

আল-জাজিরার প্রতিবেদনের পোস্টমর্টেম

আল-জাজিরার টানা এক ঘণ্টা ২০ সেকেন্ডের ডকুমেন্টারিটি দেখলাম। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারকে মাফিয়া হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করার জন্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ডকুমেন্টারিটি বানানো হয়েছে। ডকুমেন্টারিতে ‘মাফিয়া’ শব্দটি ব্যবহারও করেছে আল-জাজিরা।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (সম্ভবত ‘বিলাসী’ গল্পে) একটি উদাহরণ দিয়েছিলেন। তাঁর একজাক্ট কোটটি আমার মনে নেই। তবে কথাটি ছিল, যে ব্যক্তি রেলগাড়ীর জানালা দিয়ে বাংলাদেশের গ্রাম দেখেছেন তিনি প্রশ্ন করতেই পারেন, “ধান গাছের তক্তা হয় কিনা?” পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ যারা আল-জাজিরার ঐ ডকুমেন্টারি দেখে বাংলাদেশকে জানলেন এখন তাদের মনেও প্রশ্ন জাগতে পারে “বাংলাদেশ একটি মাফিয়া রাস্ট্র কি-না?” বিদেশীদের সেই ধারণার বীজে জল সিঞ্চনের জন্য দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক প্রোপাগেটরেরও অভাব নেই। কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশকে জানি এবং বুঝি, তাদের কাছে এই প্রতিবেদনটি কিভাবে প্রতিভাত হয়?

আল-জাজিরা তাদের প্রতিবেদনে মোটাদাগে চারটি বিষয়কে ফোকাস করেছে।

এক. বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের তিন ভাই –হারিস, আনিস এবং জোসেফ– সন্ত্রাসী এবং আল-জাজিরার দৃষ্টিতে তারা আন্তর্জাতিক মাফিয়া। হারিস যে তার এলাকায় একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন, এই তথ্যটি আল-জাজিরা গোপন করেছে। তাঁর ভাই জোসেফকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল বিএনপি সরকার, এবং সেই তালিকা যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হতে পারে –এ বিষয়ে আল-জাজিরা কৌতুহল প্রকাশের অবকাশ পায়নি। জোসেফ ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন, এটাও উল্লেখ করতে আল-জাজিরা ভুলে গেছে। ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসী মোস্তফা হত্যা মামলায় জোসেফের মৃত্যুদণ্ড এবং তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের যাবজ্জীবন হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট পরবর্তীতে জোসেফের সাজা কমিয়ে দেয়।
এই ফ্রিডম পার্টিকে আল-জাজিরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের “প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ফ্রিডম পার্টি কি আসলেই একটি রাজনৈতিক দল ছিল, বা আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মত ছিল? সেতো ছিল একটা খুনি-সন্ত্রাসী গ্যাঙ, যার মার্কা ছিল ‘কুড়াল’ – যে গ্যাঙটিকে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতো। “ফ্রিডম পার্টি” একটি নিষিদ্ধ সংগঠন –এই তথ্যটিও উল্লেখ করতে আল-জাজিরা ভুলে গেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকারী কর্নেল ফারুক, রশিদ এবং অন্যরা কিভাবে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে নামতে পারল, কারা তাদের অস্ত্র, অর্থ, পৃষ্ঠপোষকতা তথা সরকারি সুযোগ সুবিধা দিয়ে কিভাবে মাঠে নামাল –এসবের কোনো বর্ণনা প্রতিবেদনে নেই। কারণ এসব উল্লেখ করলে তাদের পারপাসটাই মাটি হয়ে যায়। শেখ হাসিনাকে কিভাবে কতবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, হারিস ও জোসেফরা কিভাবে তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তাদের প্রতি শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা থাকার বা স্নেহশীল হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারন আছে কি-না এই অ্যানালাইসিসের কোনো প্রয়োজন আল-জাজিরা দেখেনি।
শেখ হাসিনাকে সে সময় রাষ্ট্র প্রোটেকশন দেয়নি –আর্মি বা পুলিশ তার প্রাণ বাঁচায়নি –তাঁর দলের নিবেদিত কর্মীরাই বারবার মানবঢাল তৈরি করে এবং নিজেদের জীবন দিয়ে তাঁদের নেত্রীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন। এই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা জানি। শেখ হাসিনার সরকারের অনেক বিষয়ের আমি সমালোচক। কিন্তু তাঁকে রক্ষার জন্য যারা ঝুঁকি নিয়েছে তাদের প্রতি হাসিনার যে দায়বোধ, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং স্নেহশীল আচরণ একে আমি সম্মানের সঙ্গে দেখি। এদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসতে না পারলে তাঁকে যতবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল তার কোনটারই বিচার পাওয়া সম্ভব ছিল না।
১৯৯৬ সালে ফ্রিডম পার্টির গুলিবিদ্ধ সন্ত্রাসী মোস্তফা মৃত্যুর আগে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একটি জবানবন্দি দিয়েছিল বলে আল-জাজিরা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। ভিডিওচিত্রের ঐ অংশটি আমি টেনে টেনে কয়েকবার দেখেছি। ম্যাজিস্ট্রেটের অনুলেখনে (ইংরেজিতে লেখা) সেখানে মোস্তফার বয়ান হল, “হারিস আমাকে তাঁর লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়ে প্রথমে গুলি করে।” প্রশ্ন হল, একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি কিভাবে নিখুঁতভাবে বলতে পারে তাকে যে বন্দুক দিয়ে গুলি করা হয়েছিল সেটি লাইসেন্সকৃত? মোস্তফা বলেছেন, “হারিসের পর জোসেফ আমার কোমর থেকে পিস্তল নিয়ে আমার পেটে গুলি করে”। অর্থাৎ মোস্তফা কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন। যে দেশে মুদির দোকানে পিস্তল কিনতে পাওয়া যায় সে দেশের মানুষ ঐ জবানবন্দি দেখে অবাক হবেনা। মোস্তফা যদি সচেতনভাবেই বলতে পারেন, তার কোমরে পিস্তল ঝোলানো ছিল এবং জোসেফ সেটা দিয়েই তাকে গুলি করেছে, তবে মোস্তফা আসলে কি জিনিস ছিলেন সে পরিচয় পেতে আমাদের অসুবিধা হয়না। মোস্তফা জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, হারিস এবং জোসেফ ছাড়া অন্যরা তাকে ‘র্যান্ডামলি’ গুলি করেছে। তাকে নয়টি গুলি করা হয়েছে –একথাও মোস্তফা তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন। একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি নিজের দেহে নয়টা গুলি লাগার কথা গুনে গুনে বলতে পারে –এটা শুনে আমি হতবাক হয়েছি। কিন্তু আল-জাজিরার প্রতিবেদক এতে অবাক হননি। মোস্তাফার বর্ণনা অনুযায়ী জোসেফ তার কোমর থেকে পিস্তল নিয়ে তাকে গুলি করলে জোসেফের অবস্থান ছিল মোস্তফার শরীরের একেবারে সন্নিকটে। সেসময় অন্যরা মোস্তফার প্রতি এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করলে সেই গুলি জোসেফের শরীরেও লাগার কথা। তাহলে জোসেফ কেমনে অক্ষত থাকে?
মৃতব্যক্তির ডায়িং ডিক্লেয়ারেশনের ভিত্তিতেই বিএনপি আমলে জোসেফ এবং অন্যদের সাজা দেওয়া হয়েছিল। সে জবানবন্দিতে মোস্তাফার স্বাক্ষর ছিল না, হাতের ছাপও ছিল না। বিএনপি সরকারের নিয়োগকৃত ম্যাজিস্ট্রেট কিভাবে ঐ জবানবন্দি বানিয়েছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ আছে। মোস্তফা আসলে কবে এবং কোথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। মৃত্যুর ঘোষণাপত্রে বলা হয়, গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল সিডিএস প্রিন্টিং প্রেসে –যা অন্য একটি দলের সঙ্গে হয়েছিল এবং সেটি ১৯৯৬ সালের ৫ মে হয়েছিল। আর এফআইআর-এ বলা ছিল ৭ মে। জোসেফ এবং তাঁর ভাইদের ফাঁসানোর জন্য ঘটনাকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছিল বলে তাঁদের আইনজীবী বহুবার আদালতকে বলেছে। মামলাটি নিয়ে এরকম অনেক বিভ্রান্তি আছে, যা বিস্তারিত করছি না। আমি মনে করি সরকারের উচিত কোর্টের অনুমতি নিয়ে ঐ মামলাটি পুনঃদতন্ত করা। কারণ এর সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িয়ে গেছে।
দুই. প্রতিবেদনের অভিযোগ, আমাদের সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে তাঁর প্রবাসী ভাইয়েরা যোগাযোগ রাখেন এবং পারিবারে বিয়েসাদীর মত অনুষ্ঠানেও তাঁরা যোগ দিয়েছেন। আল-জাজিরা এই তথ্য দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছে, আমাদের সেনাপ্রধানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের যোগাযোগ আছে। হারিস বা তাঁর অন্যকোনো ভাই কি আসলেই আন্তর্জাতিক মাফিয়া? বাংলাদেশের একটি হত্যা মামলা ছাড়া হারিস বিদেশে কোথাও কোনো অপরাধ কর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন –এর কোনো প্রমাণ বা ন্যুনতম তথ্য আল-জাজিরা তুলে ধরতে পারেনি।
আল-জাজিরা হারিসকে আন্তর্জাতিক মাফিয়া বলেছে। প্রতিষ্ঠানটি তাহলে বিএনপি নেতা তারেক রহমান সম্পর্কে কি বলবে? তারেক রহমান ২১ আগস্টের বোমা হামলা মামলায়, ১০ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের মামলায়, এবং একাধিক দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অপরাধী। জঙ্গিদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। তিনি কি তাহলে আন্তর্জাতিক মাফিয়া? তিনি কিভাবে পলাতক অপরাধী হয়েও একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সিনিয়র ভাইসচেয়ারমান থাকতে পারেন? তাহলে বিএনপি সম্পর্কে আমরা কি বলব?
সেনাপ্রধান আজিজের সঙ্গে তাঁর আপন ভাই যোগাযোগ রাখেন –এটি জেনে আমাদের অবাক হওয়ার কারণ নেই। তিনি তাঁর ভাইয়ের প্রতি স্নেহশীল হবেন, তাঁকে ভাল রাখার জন্য চেষ্টা করবেন, তাতেই বা বিস্ময়ের কি আছে? আমাদের পরিবারের কেউ মামলা মোকদ্দমায় আসামী হলে আমরা কি তাদের সহযোগিতা করি না?
তিন. প্রবাসী হারিস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আলোচনা করেছেন। আল-জাজিরা এই বিষয়টি বিশেষভাবে ফোকাসে এনেছে। বিষয়টি সত্য হলে আমি বলব, একজন পলাতক ব্যক্তিকে এরকম সুযোগ দেয়া উচিত হয়নি। তবে ঐসব সেনাসরঞ্জাম (বন্দুকের কার্তুজ) বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত আদৌ কিনেছিল কিনা এবং কিনে থাকলেও তাতে দুর্নীতি হয়েছিল কিনা, দুই টাকার জিনিস পাঁচ টাকা দিয়ে কিনে দেশের ক্ষতি করা হয়েছিল কিনা –এরকম কোনো তথ্য আল-জাজিরা হাজির করতে পারেনি।
চার. পলাতক হারিস একসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ছিলেন এবং তার প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্নেহের দৃষ্টি আছে। কারণ সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রাণরক্ষায় বড় অবদান রেখেছিলেন। এই বিষয়টি আল-জাজিরার চোখে বড় অপরাধ। আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা হারিসের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সকৃতজ্ঞ স্নেহকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন? এখানে দুই ধারার মানুষ আছে। “মাগো তোমায় কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব,” এই স্লোগান যাদের রক্তে বোধের অনুরণন ঘটায় তাদের সেন্টিমেন্ট একরকম। অন্যদিকে যারা সবসময় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখার মধ্যে শান্তি খুঁজে পায়, তাদের সেন্টিমেন্ট অন্যরকম। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের চোখে সন্ত্রাসী, আমাদের চোখে বীর। খুনি ফ্রিডম পার্টি ও তার সহযোগী পৃষ্ঠপোষকদের কাছে শেখ হাসিনার উপর আক্রমণকারীরা বীর, একজন দেশপ্রেমিকের চোখে হাসিনার রক্ষায় যারা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাঁরাই সম্মানিত অগ্রসেনা।
লেখক: পুলক ঘটক, সাংবাদিক