প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে কী অর্জন হলো এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা যত না, তার চেয়ে বেশি বাইডেনের সেলফি নিয়ে। এ বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে অন্য যুক্তি তুলে ধরে আওয়ামী লীগের শীর্ষসারির নেতারা দাবি করেন, নির্বাচনের আগে ভারত সফর বিশ্ব রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চাপমুক্ত করতে পেরেছে। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধু ভারতই করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সমাধান করতে হবে। এগুলো বিদেশিদের সামনে এনে সমাধান হবে না।
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি তোলার ঘটনা প্রচার করে আওয়ামী লীগ বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আদতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের নড়চড় হয়নি।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতিতে জটিলতা চলছে। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা জানিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, মন্ত্রী ও সরকারি দল, বিরোধ দল ও মাঠের বড় দল বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে এক দফা দাবিতে অনড়। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করতে রাজি নয়। এ অবস্থায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।
এ নিয়ে আওয়ামী লীগ চাপে রয়েছে, এমন খবর গণমাধ্যমে আসে। এমনকি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কয়েকজন মন্ত্রী নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের মোদি সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূতিয়ালি করছে বলে ভারতের কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
এ প্রেক্ষাপটে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার ও আওয়াম লীগ। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা ও সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারত সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালি হাতে ফেরেননি। ভারত সফরে গিয়ে ভারত জয় করে এসেছেন তিনি।
তারা দাবি করছেন, ভারতকে যেমন ‘মুঠোবন্দি’ করেছেন তেমনি সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব দূর করার ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত মাঠের বিরোধী দল বিএনপি দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল তাতে হোঁচট খেতে হলো দলটিকে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক মন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে প্রত্যাশা নিয়ে সফরে গেছেন প্রধানমন্ত্রী তা পূরণ হয়েছে। এর প্রকাশ ঘটতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে সাধারণ মানুষকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শেষ কথা হলো বাংলাদেশের জন্য পরম মর্যাদা নিয়ে ফিরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।’
কূটনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এমন এক নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্ব নেতাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই দেশটির সবচেয়ে কাছের মিত্র। তিনি এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে।’ এর সঙ্গে দুটি ঘটনা তুলে ধরে এ নেতা আরও বলেন, ‘প্রথমত দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশ জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি। ভারত বাংলাদেশকে যে গুরুত্ব দেয়, এটি তার প্রমাণ। আরেকটি বিষয় হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির নিজের বাড়িতে দাওয়াত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খাওয়ানো। সেখানে অন্য দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান থাকলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু তার দৃষ্টান্ত দেখালেন মোদি। তিনি বোঝালেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক নিয়ে নানা গুজব থাকলেও সেটি মিথ্যা। প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবে ভারত সরকার।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান জো বাইডেন সেলফি তোলায় রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র জয় করার যে উত্তাপ দেখাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা, তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলী ও সম্পাদকম-লীর দুজন সদস্য। তারা বলেন, সেলফি বড় কোনো বিষয় নয়। এ সেলফি নিয়ে যারাই যে ব্যাখ্যা দিয়ে বেড়াক, সেটা গুরুত্বহীন। কারণ এ ধরনের অনুষ্ঠানে সেলফি তোলাতুলি হয়ই। তবে এ অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের যে কথোপকথন হওয়ার সুযোগ মিলেছে, সেলফির চেয়েও সেটা বড় ঘটনা। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এ দুই নেতা আরও বলেন, জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কর্মকান্ডে এ দাবি করা যায় যে, ভারত জয় করেই ফিরেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক নেতা দাবি করেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এখনকার চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষমতাশালী ছিল। যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশটির বিরোধিতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে। শক্তির বিবেচনায় তখনকার তুলনায় এখন যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এ নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। এর অন্যতম হলো খাদ্যদ্রব্যের দাম জনগণের নাগালে রাখা। জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা। মোটামুটি অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, সেখানে ৫০ ভাগ ভোটার ভোট দেয় তাতেই সব ঠিক করা সম্ভব হবে। এর মধ্যে যেকোনো কৌশলে সব দলকে নির্বাচনে আনতে পারলে সব প্রতিকূল পরিস্থিতিই ‘ওভারকাম’ (জয়) করা সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সম্পর্কে জানতে চাইলে এ নেতা বলেন, ‘এসব অনুষ্ঠান ফরমাল। এখানেই সব ডিলিং হয়ে যাবে ব্যাপারটা এরকম ভেবে নিলে হবে না। তবে এ সফরের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হলে সবচেয়ে বড় সফলতা এসেছে, সেটি মানতেই হবে।’
তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তিনি মূলত বিশ্ব নেতাদের অবহিত করেছেন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক। এ বিষয়টি বাংলাদেশের উত্তাল রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ফেবার (সুবিধা) দেবে।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য ঠিক এমন বোঝাপড়ার কথা তুলে ধরে দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে প্রতিবেশী দেশটি নিয়ে যেসব গুঞ্জন মাঠে ছিল, সেটা আর ধোপে টিকবে না।
ভারত সফর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মি আহমেদ কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কেও টানাপড়েন কখনো ঘটেনি, সামনেও ঘটবে না সে বিষয়টা বিশ্ববাসীকে বুঝতে সুবিধা করে দিয়েছে এই জি-২০ সম্মেলন।’ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে মাঠে আন্দোলনরত বিএনপি বুঝলে তাদের জন্য ভালো হবে। না বুঝতে পারলে যা হওয়ার কথা তাই হবে মন্তব্য করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ এ নেতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত পরমবন্ধু তা সর্বজনবিদিত। গত ১২-১৩ বছরে সম্পর্কের উষ্ণতা উচ্চমাত্রায় পৌঁছেছে সেটাও সবাই দেখেছে। তবে সর্বশেষ সফরে কী নিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গেলে আমি বলব, আরও সময় নিয়ে বলা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এ সফরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে যা এসেছে, দেখেছি ও পড়েছি; তাতে এটুকু বলতে পারি। এখানে অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার দেখা যায়নি। সম্পর্ক স্বাভাবিকই রয়েছে। এজ ইট ইজ।’
সম্পর্ক ঠিকই আছে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদও। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারত একে অন্যের অকৃত্রিম বন্ধু। সে সম্পর্কে কোনো হোঁচট খেয়েছে এটা বলা যায় না।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) এসব বিষয়গুলো জি-২০ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আর এ বিষয়গুলো নিয়ে যেহেতু সরকার কাজ করেছে এ ধরনের বিশ্বসভায় সেসব বিষয়ে আলোচনা হওয়া খুবই প্রয়োজনীয় ছিল।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের একটা বিশ্বসভায় বিশ্বের বহু নেতার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় বৈঠক হবে এটাই স্বাভাবিক। সে অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে আমার মনে হয় না। হলেও খুব সামান্য সময়ের জন্য হয়েছে। সেটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে খুব প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।’
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ যেসব সমস্যা রয়েছে, সেসব দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী সমাধান করতে হবে আমাদের। এটাই প্রধান সোপান। অহেতুক যুক্তরাষ্ট্র বলেন, ভারত বলেন বা অন্যান্য দেশকে সামনে এনে এর সমাধান হবে না, বরং জটিল হয়ে পড়ে।’
আওয়ামী লীগকে ‘সেলফি রাজনীতির’ খোঁচা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাইডেনের সঙ্গে একটা সেলফি তুলে এখন ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন, আহা, আমরা জিতে গেছি। জেতাবে তো বাংলাদেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে। সেই ভোটটা ঠিকমতো হওয়ার ব্যবস্থা করেন। তা না হলে কোনো বাইডেনেই আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না, সেলফিও রক্ষা করতে পারবে না।’