হিন্দু নারীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার, বিয়ে নিবন্ধন, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা অবসানের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে গত ৩ মে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়। রিটকারীদের মধ্যে আছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, অভিযানসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মাহবুব উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটটি গ্রহণ করে সরকারের ওপর রুল জারি করেন। কিন্তু রিটকারীদের বিরোধিতা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি পক্ষ ইতোমধ্যে মানববন্ধন, মিছিল ইত্যাদি করেছে। অন্যদিকে সংস্কারের জন্য হিন্দু সমাজেরই আরেকটি পক্ষ কয়েক দশক ধরে আন্দোলন করছে। কিন্তু উভয় পক্ষের এই বিপরীত মেরুতে অবস্থান কখনও কখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবল তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। কেউ কেউ পরস্পরকে অশ্লীল শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আক্রমণ করে ব্যক্তিগতভাবে হেনস্তা করারও চেষ্টা করেন, যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। যে কোনো বিষয়ে মতের অমিল থাকতেই পারে। সে বিষয়ে যৌক্তিক আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এ বিষয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমাধানে পৌঁছাতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে পরিষদের সাবেক সভাপতি কাজল দেবনাথকে আহ্বায়ক এবং জয়ন্ত সেন দীপুকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি নিশ্চয় তাদের কার্যক্রম চলমান রেখেছে।
হিন্দু আইন সংস্কারে বিরুদ্ধপক্ষের যুক্তি– শাস্ত্রীয় আইন অপরিবর্তনীয়। গত ২৫ জুন ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন হলে সামাজিক ও ধর্মীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে’ শিরোনামে ৫৫ বিশিষ্টজনের বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন দায়ভাগ আইন নামে প্রসিদ্ধ, যা দ্য হিন্দু উইমেনস রাইট টু প্রপার্টি অ্যাক্ট ১৯৩৭-এর মাধ্যমে সংস্কার ও সংযোজন করা হয়।’ অর্থাৎ ওই বিশিষ্টজনের মতে, শাস্ত্রীয় ‘দায়ভাগ’ আইনটি ব্রিটিশ সরকার সংস্কার করলেও এতে ধর্মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি! ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা বিলোপ আইন, ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ প্রচলন আইন প্রণয়নসহ ব্রিটিশ আমলে ডজনখানেক আইন প্রণয়ন এবং পরবর্তী সমেয় ভারত, নেপাল ও মরিশাসে হিন্দু আইন সংস্কার ও পরিবর্তনের ফলেও ধর্মের কোনো অবমাননার উদাহরণ দৃশ্যমান নয়।
হাইকোর্টের রুলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের ব্যক্তিগত মতামত-সংবলিত একটি সাক্ষাৎকার ৪ জুন সমকালে ছাপা হয়। রানা দাশগুপ্ত একজন আইনজীবীর বাস্তব অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার না থাকা, বিয়ে নিবন্ধন না করলে দম্পতির বিদেশ গমনে জটিলতা তৈরি হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে যেমন কথা বলেছেন, তেমনি সমাজের রক্ষণশীলতার পাশাপাশি হিন্দুদের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন-নিপীড়নের বাস্তবতায় তাদের কষ্ট ও আতঙ্কের কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, হিন্দু নারীদের শিক্ষিত ও সচেতন অংশ বেশ কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি সংস্থা স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট হিন্দু নারীর উত্তরাধিকার নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে। এতে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপি যেমন হিন্দু নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন, তেমনি দক্ষিণবঙ্গের গ্রামের একাধিক সাধারণ নারীও সংস্কারের পক্ষে কথা বলেছেন।
এগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে গত ১৬ জুন একটি হিন্দু নারী সংগঠন সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড করার অভিযোগে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, আরমা দত্ত এমপি ও অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তকে সমাজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। তারা এসব ব্যক্তিকে কোনো মন্দির ও হিন্দু ধর্মীয় কোনো শুভকাজে নিমন্ত্রণ না করার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান। অবশ্য তাদের এ অনুরোধ ইসকনের মতো প্রতিষ্ঠান রাখেনি, যে প্রতিষ্ঠানের হাজারো অনুসারী ভক্ত রয়েছেন এবং যে প্রতিষ্ঠানটি হিন্দু ধর্ম রক্ষা ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইসকন গত ২৭ জুন উল্টোরথ উৎসবের দিনে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যকে প্রধান অতিথি করেছে। যারা দেশের ওই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন, তারা নিশ্চয় জানেন– হিন্দু ধর্মে বর্ণভেদে ১০, ১২, ১৫ ও ৩০ দিন জন্ম-মৃত্যু অশৌচ পালনের যে বিধান রয়েছে; সময়ের ব্যবধানে অনেকেই তা থেকে সরে এসেছেন। এমনকি হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতিও ১০ দিন অশৌচ পালনকে যৌক্তিক মনে করে। নিষিদ্ধ থাকা অসবর্ণ বিয়ে এখন বাংলাদেশেও বাস্তবতা। পক্ষ-বিপক্ষ থাকায় সরকার ঐচ্ছিক রেখে ২০১২ সালে হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু যারা নিবন্ধন আইনের বিপক্ষে ছিলেন, তাদের কাউকে কাউকে বিবাহিত সন্তানকে বিদেশে পাঠানোর তাগিদে নিবন্ধন করাতে দেখা গেছে। এমনকি কেউ কেউ হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রেশন সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ইউনিফরম সিভিল কোড করার পক্ষে মতামত রাখছেন। কেউ কেউ হিন্দু আইন সংস্কারের আগে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি তুলেছেন। আবার কেউ কেউ কেবল স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার দিতে ইচ্ছুক। তবে ইউনিফরম সিভিল কোড প্রণয়ন বা সুরক্ষা আইনের পর উত্তরাধিকার আইন সংস্কার বা স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার দিলে কি ধর্মের ব্যত্যয় ঘটবে না? সামাজিক বাস্তবতায় ধর্মান্তরকরণের ভীতি হিন্দু সম্প্রদায়ের যন্ত্রণার অন্যতম কারণ, সন্দেহ নেই। তবে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ লজ (রিভিশন অ্যান্ড ডিক্লারেশন) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রণীত দ্য কাস্ট ডিজঅ্যাবিলিটিজ রিমুভাল অ্যাক্ট ১৮৫০ বাতিল করা হয়েছে। ভারতেও ২০১৭ সালে এটি বাতিল করা হয়। ফলে ধর্মান্তরিত হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কারও পক্ষেই পৈতৃক সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হওয়ার সুযোগ নেই।
জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ ও ১৯৭৯ সালে প্রণীত সিডও সনদে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে লিঙ্গ সমতার বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। একদিকে সংবিধানের কথা বলে সমঅধিকার, সমমর্যাদার লড়াই; অন্যদিকে নারীকে অধিকারবঞ্চিত রেখে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে কি? তাই সময় হয়েছে উভয় পক্ষের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার। মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণণ রামস্বামী গত ২১ জুন এক রায়ে বলেছেন, স্বামী নিজে যত সম্পত্তি কিনবেন, তার অর্ধেকাংশের অধিকার গৃহবধূ স্ত্রীর থাকবে। একই হাইকোর্টের বিচারপতি এন আনন্দ ভেঙ্কটেশ ২৭ জুন এক রায়ে বলেছেন, জাতপাত বা বংশ পুরোহিত নিয়োগের মাপকাঠি হতে পারে না। হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু ধর্ম অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে সময়ের প্রয়োজনে সংস্কারের মাধ্যমে টিকে আছে। ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।
মিলন কান্তি দত্ত: সমাজকর্মী