Skip to content

হিন্দু আইনের নিষ্ঠুরতা

হিন্দু আইনের উপর যতই পড়াশোনা করছি, ততই মানুষের প্রতি অবিচার দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হচ্ছি। ধর্মের নামে এবং প্রথার নামে যে অমানবতা ও নিষ্ঠুরতা মানুষের উপর চাপানো হয়েছে তা কোনো সৎ ও হৃদয়বান মানুষ মেনে নিতে পারে না।

একজন মানুষ দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত- হিন্দু আইনে এটা তার অপরাধ। এজন্য তার পিতার শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানের অধিকার নেই এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি সম্পত্তিতেও অধিকারহীন।
মহর্ষী যাজ্ঞবল্ক বলে গেছেন, বর্ণচ্যুত ব্যক্তি, তার সন্তানরা এবং দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা উত্তরাধিকার পেতে পারে না। তবে তারা সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী।
মনুসংহিতা বলছে,

“অনংশৌ ক্লীবপতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা।
উন্মত্তজড়মূকাশ্চ যে চ কেচিন্নিরিন্দ্রিয়াঃ।।” (৯/২০১)

অর্থ: ক্লীব (পুরুষত্বহীণ), পতিত (বর্ণভ্রষ্ঠ), জন্মান্ধ, বধির, উন্মত্ত, জড়, চেতনহীন, মূক (বোবা), কালা (শ্রবণশক্তিহীন) প্রভৃতি বিকলেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা কেউই পৈত্রিক ধনসম্পত্তির অংশিদার হবে না। (৯/২০১)।

“সর্বেষামপি তু ন্যায্যং দাতুং শক্ত্যা মনীষিণা।
গ্রাসাচ্ছাদনমত্যন্তং পতিতো হ্যদদদ্ভবেৎ।।” (৯/২০২)

অর্থ: তবে যারা ধনসম্পত্তির ভাগিদার হবে, তারা সুবিবেচনাপূর্বক যথাশক্তি ঐ সব ক্লীব প্রভৃতিকে যাবজ্জীবন গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করবে। তা না করলে তারা পতিত হবে।
তারমানে বাড়ির একটি পোষাপ্রাণীকেও যেমন সাধ্যমত খাবার দিতে হয়, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, ক্লীব তথা ভিন্নলিঙ্গের মানুষের প্রতি তেমন মানবতা দেখাতে হবে।

বলাবাহুল্য সাবেকি চিকিৎসা বিদ্যায় যেসব রোগ দূরারোগ্য হিসেবে চিহ্নিত ছিল, আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে তার প্রায় সবগুলোই নিরাময়যোগ্য। এখন প্রয়োজন আইনের নিরাময়। প্রাচীন বৈদ্যবিদ্যার অনুসরণে কুষ্ঠরোগীসহ যাদের স্বাস্থ্যগতকারণে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিধি দেওয়া হয়েছে, জ্ঞানবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তা আজ একেবারে অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে।

হিন্দু বিধানের এহেন নিষ্ঠুরতা, অন্যায্যতা ও অমানবিকতা অনেকটা নিরসন করে গেছে ইংরেজরা। ব্রিটিশ সরকার ১৯২৮ সালের উত্তরাধিকার অযোগ্যতা দূরীকরণ আইন (The Hindu Inheritance Removal of Disabilities Act 1928) প্রণয়ন করে এ সংক্রান্ত নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, ১৯২৮ সালের ঐ আইন অবিভক্ত বাংলায় ‘দায়ভাগ’ অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য হয়নি। আর স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ও সংসদ মানবাধিকারের প্রতি কতটা সংবেদনশীল মধ্যযুগীয় বর্বর আইনগুলোর প্রতি সুদীর্ঘকালের অবহেলাতেই তা বোঝা যায়।

বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রের রচয়িতারা উত্তরাধীকার প্রশ্নে নারীদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে গেছেন। নারীরাও হিন্দু আইনের দৃষ্টিতে পাগল, প্রতিবন্ধী, মুক, বধীর ও কুষ্ঠরোগীর সমতুল্য। নারীদের অধিকার অস্বীকার করে মনুসংহিতার মনু বলছেন,

“অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্য্যাঃ পুরুষৈঃ স্বৈর্দ্দিবানিশম্
বিষয়েষু চ সজ্জন্ত্যঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে॥”

অর্থ: স্ত্রীলোকদের স্বামী প্রমুখ ব্যক্তিরা দিনরাত পরাধীন রাখবেন, নিজেদের বশে রাখবেন।

নারীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ করে তিনি বলছেন,

“পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে
রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি॥”

পন্ডিতপ্রবর মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের পদ্যে এর বাংলা হলো,

”জনক করিবে রক্ষণ শৈশব যখন,
যৌবনে রক্ষিবে পতি করিয়া যতন ;
বৃদ্ধকালে রক্ষা তারে করিবে তনয়,
স্বাধীনতা অবলারে দেওয়া ভাল নয়।”

তদনুযায়ী ’দায়ভাগে’ সম্পত্তিতে নারীর অধিকার হরণ করে গেছেন পন্ডিৎ জীমুৎবাহন। হিন্দু মহাপন্ডিতদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রখ্যাত আইনবিদ ও বিচারক গাজী শামছুর রহমান তার হিন্দু আইনের ভাষ্যে লিখেছেন,

“হিন্দু নারীর স্বাধীনতার অধিকারের এই ক্ষীণতা যে তাহাদের কোন অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্তি বা অসাবধনতা বা মনোযোগের অভাবের ফল ইহা ঠিক নয়। তৎকালীন পণ্ডিতগণ সচেতনভাবে বিষয়টি চিন্তা করিয়াছিলেন এবং তাহাদের পরিবারে ও সংসারে তাহাদের অবস্থান বিবেচনা করিয়া এইরুপ নির্দেশ দিয়াছিলেন। হিন্দু নারীরা সাধারণত: অধিকতর মমতাময়ী এবং ভাবালু। সম্পত্তি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় দৃঢ়তা তাহাদের চরিত্রে অবর্তমান। এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করিয়া তাহারা নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, নারীগণ তাহাদের স্বামী ও পিতার উপর নির্ভরশীল হইবেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তাহার উত্তরাধিকারীগণ তাহাদিগকে প্রতিপালন করিবেন।”

ডক্টর সর্বাধিকারী তার ”হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে নীতি” বইয়ে লিখেছেন,

“বশিষ্ট বৌধায়নের সহিত একমত হইয়া বলেন যে, নারীবৃন্দকে কোন স্বাধীনতা দেওয়া যাইবে না। নারীবৃন্দ সর্বদা চিরস্থায়ী অভিভাবকত্বের অধীন থাকিবে। তাহারা নিজদিগকে রক্ষা করিতে অসমর্থ এবং তদাবস্থায় ইহা আশা করা যায় না যে উত্তরাধিকার পাইলে তাহা তাহারা সংরক্ষণ করিতে পারিবে। পারিবারিক সম্পত্তি পরিচালনা করা তাহাদের পক্ষে কঠিন। তাহারা তাহাদের স্থানে থাকুন ইহাই কাম্য। তাহাদের স্থান হইতেছে গৃহের নিভৃতে; সেখানে তাহারা দেবী। দেবীত্বের সিংহাসনে সমাসীন হইয়া তাহারা ভক্তের নৈবেদ্য গ্রহণ করিতে থাকুন। পরিবার একটি সংস্থা। সেই সংস্থার কর্ণধার হইবার যোগ্যতা তাহাদের নাই। তাহারা অশক্ত ও অবলা এবং সম্পত্তি রক্ষার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন তাহা তাহাদের নাই। হিন্দু সমাজে জ্ঞানে ও বিদ্যায় পারদর্শীনী বহু নারীর সন্ধান পাওয়া যায় কিন্তু শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দিয়াছেন এমন কোনো উদাহরণ দেখা যায় না।“

নারীরা কি আসলেই শক্তি এবং বীরত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না? কথাটি ডাহা মিথ্যা। এমনকি মহাভারতে বিদ্ধৃত সত্যও পন্ডিতরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে গোপন করেছেন।

মহাভারতে স্বয়ং বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনকে হরণপূর্বক বিয়ে করেছিলেন একজন নারী; নাম তার সুভদ্রা। অর্জুনের দ্বিতীয় স্ত্রী উলুপীও ছিলেন মহাবীর। তার আরেক স্ত্রী মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা একজন যুদ্ধবিদ্যা পারঙ্গম সেনানায়ক এবং প্রজাদের আশ্রয়স্থল ছিলেন। যাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরুষের সমকক্ষ করে নারীর পরিচয় এঁকেছেন এই ভাষায়,

“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।”

মহাভারতে যোদ্ধা নারীর আরও উদাহরণ আছে। সনাতন ধর্মের মূল বৈশিষ্ট অনুযায়ী নারী সর্বশক্তিময়ী এবং রক্ষাকারিণী। নারী মা দুর্গা, নারী রক্ষাকালী। সর্বশক্তিরূপা জগন্মাতাই সকল নারীতে মাতৃরুপে বিরাজিতা। বলা হয়েছে, নারী চিরন্তন; সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশের শক্তি –”সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।”

সেই শক্তিভূতা হিন্দুশাস্ত্রের কোনো দুরবর্তী কল্পনার দেবী নন। পরিস্কার ভাষায় বলা হয়েছে তিনি ”সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।” পৃথিবীর সকল নারীই সেই শক্তি স্বরুপা। নারীরা আসলে বৈশিষ্টগতভাবে গৃহবন্দিনী নয়। তারা মন্ডপে বা পূজাবেদিতে স্থানু হয়ে থাকা প্রাণহীন প্রতিমা নয়। তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। ইতিহাস গোপন করা হয়েছে এবং ষরযন্ত্রমূলক মিথ্যাচার করা হয়েছে।

মনু সংহিতার মনু থেকে শুরু করে অধিকাংশ পুরুষ শাস্ত্রকার নারীদের সামর্থহীনা হিসেবে দেখিয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাদের অধিকার হরণ করেছেন। তাদের স্থানু করে দিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে ঐসব শাস্ত্রকার সনাতন ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছেন সন্দেহ নেই।

শাস্ত্রকারদের ধর্মীয়, নৈতিক এবং বিবেকবিচ্যুতির বিষয়ে সন্দেহ আরও থাকেনা, যখন আমরা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীকে সম্যকভাবে দেখতে পাই। সেনানী, সেনাধ্যক্ষ্য, সেনানায়ক এমনকি বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে আমরা নারীদের দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং প্রাচীন শাস্ত্রকারদের ঐসব কটুবাক্য আজ একেকটি প্রমাণিত মিথ্যা। তবুও প্রথা এবং কুসংস্কারের এমনই শক্তি যে, আজ পর্যন্ত আইনগতভাবে বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের সমঅধিকার দেয়া সম্ভব হয়নি। ভারত এবং নেপালের মতো হিন্দুপ্রধান দেশে আইন সংশোধন হয়েছে।

বাংলাদেশের আইনে এখন পর্যন্ত হিন্দু নারীদের যতটুকু অধিকার আমরা দেখতে পাচ্ছি তা দিয়ে গেছে ইংরেজরা, অর্থাৎ সাদা চামরার সেই বিদেশীরা। আমরা ’গর্বিত বিজয়ী বাঙালি’ তা পারিনি। ১৯৩৭ সালে ইংরেজরা সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার সংক্রান্ত The Hindu Women’s Rights to Property Act 1937 প্রণয়ন না করলে, অর্থাৎ পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের সমাজে প্রচলিত প্রথাভিত্তিক বিধিবিধান সর্বাংশে চালু থাকলে এদেশের হিন্দু নারীরা এখন যতটুকু অধিকার ভোগ করছে তাও থাকত না।

ইংরেজ গেছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা পরাধীন রয়ে গেছে। এবার নারীদের, বিশেষত: শিক্ষিত নারীদের, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা পরাধীন থাকবে কি-না? সঙ্গে কর্তৃত্বধর পুরুষদেরও ভাবতে হবে, তারা অধিকার হরণকারী বর্বরদের কাতারে অবস্থান নেবে, না-কি মানুষ হবে।

#  এশিয়া বার্তা’র সমঝদার পাঠকদের কাছে আমরা পুলক ঘটকের এই লেখাটির বিষয়ে  সুচিন্তিত মতামত প্রত্যাশা করি  #

লেখক: পুলক ঘটক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

ইমেইল :  ghatack@gmail.com