মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের দূত স্টিভ উইটকফ বুধবার ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন । এই বৈঠকের লক্ষ্য হচ্ছে ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধের পর হামাস জঙ্গিদের সঙ্গে ইসরায়েলের ভঙ্গুর অস্ত্রবিরতিকে জোরালো করা।
ছয় সপ্তাহের এই সন্ধিকে রূপ দিতে যিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন সেই উইটকফ পরে গাজাকে পৃথক করেছে এমন ৬ কিলোমিটার চওড়া নেতজারিম করিডর পরিদর্শন করেন। সেখানে বাস্তুচ্যূত ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তনে নজরদারি করতে আমেরিকান নিরাপত্তা ঠিকাদারদের ভাড়া করা হয়েছে।
বেশ কয়েক বছরের মধ্যে উইটকফ হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সব চেয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি গাজা সফরে গেলেন। নিরাপত্তা জনিত উদ্বেগ এবং যুক্তরাষ্ট্র অভিহিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে কোন রকম সংযোগ না রাখার নীতির কারণে আমেরিকান কর্মকর্তারা ভূমধ্যসাগর বরাবর এই সরু অঞ্চল থেকে দূরে থেকেছেন।
গত সপ্তাহে উইটকফ ফক্স নিউজকে বলেন যে তিনি গাজা-মিশর সীমান্ত বরাবর ফিলাডেলফি করিডরেও যাবার পরিকল্পনা করছেন তবে তিনি কখন সেখানে থামবেন সেটা পরিস্কার ছিল না।
ইসরায়েলি সৈন্যরা ওই ১৩ কিলোমিটারের করিডরটি নিয়ন্ত্রণ করে তবে আশা করা হচ্ছে এই অস্ত্রবিরতির দ্বিতীয় পর্বে তারা সেখান থেকে সরে আসবে এবং এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিষয়টি নিয়ে এখনও ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে আলোাচনা চলছে। নেতানিয়াহু এই করিডরকে জঙ্গিদের চোরাচালান তত্পরতার মূল শক্তি বলে অভিহিত করেছেন।
এই সপ্তাহান্তে নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে আলোচনার জন্য ট্রাম্প তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে এই দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প এই প্রথম কোন বিদেশী নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
ইতোমধ্যেই গাজায় অস্ত্রবিরতির সময়ে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে সামরিক অভিযান বৃদ্ধি করেছে। বুধবার জেনিন সফরের সময়ে পশ্চিম তীর প্রসঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন ইসরায়েল “ জুদিয়া ও সামারিয়ায় ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে”।
তিনি বলেন, “জেনিন শরণার্থী শিবির আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। এই অভিযান সম্পন্ন হলে [ ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী] ওই শিবিরে থাকবে এটা নিশ্চিত করতে যে সন্ত্রাসবাদ যেন ফিরে না আসে”।
নেতানিয়াহুর সফরের আগে, উইটকফ অস্ত্রবিরতির যথার্থ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। এই অস্ত্রবিরতির কারণে লড়াই বন্ধ হয়েছে এবং এ পর্যন্ত হামাস সাতজন পণবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে এবং ইসরায়েল আটক ৩০০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে।
সামনের দিনগুলিতে আরও বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।
এই অস্ত্র বিরতির প্রথম পর্যায়টির মেয়াদ ৪২ দিন , যার এক চতুর্থাংশ সময় শেষ হয়েছে। এই সময়ে গাজা থেকে ৩৩ জন পণবন্দির মুক্তি দেওয়ার কথা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে অবশিষ্ট পণবন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হবার কথা যাতে এই সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়।
গাজার উত্তরাঞ্চলসহ ইসরায়েলি সৈন্যদের দখলে থাকা বেশ কিছু এলাকায় এখন ফিলিস্তিনিদের ফিরে আসতে দেওয়া হচ্ছে। বুধবার জাতিসংঘ জানিয়েছে গাজার উত্তরাঞ্চলে এই সপ্তাহে ৪,২৩,০০০ লোক ফিরে এসেছেন।
যুদ্ধের প্রথম দিকে ইসরায়েলের নির্দেশে দশ লক্ষ লোক ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেনএবং এখন যারা ফিরে আসছেন তারা যে অঞ্চলে যাচ্ছেন সেটি হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভিযানে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
অস্ত্র বিরতির আওতায়, জাতিসংঘ গাজায় মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি করছে । মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবিক দপ্তর জানায় যে সাহায্যের চালান “অর্থবহ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে” এবং সাহায্য কর্মীরা আগে যে সব এলাকায় যেতে পারতেন না এখন সেখানেও যাচ্ছেন।
সংস্থাটি বলছে, “সেখানে সরেজমিনে মূল্যায়ন করে দেখা গেছে বিশেষত গাজার উত্তরাঞ্চলে জল ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে এবং এর ফলে মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর জন্য পূণর্বাসন ও পূনর্গঠনের কাজ বৃদ্ধি করার জরুরি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
অস্ত্রবিরতি চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে মূল দিকটি হচ্ছে গাজার পুণর্নির্মাণ এবং একই সঙ্গে এটাও নির্ধারণ করা যে ওই অঞ্চলটি কারা শাসন করবে। ২০০৭ সাল থেকে সেটি হামাসের শাসনের অধীনে ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আব্দেলাতির সঙ্গে ফোনালাপে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও “হামাস যাতে আর কখনও গাজা শাসন করতে না পারে কিংবা ইসরায়েলকে হুমকি দিতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে সংঘাত-উত্তর পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিতে” একত্রে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।
কয়েক মাস ধরে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতার ছিল প্রধান মধ্যস্থতাকারী দেশ যার ফলে এই অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সাম্প্রতিক দিনগুলিতে ট্রাম্প বার বার তাঁর এ রকম পরামর্শের জন্য সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন যে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে প্রতিবেশি রাষ্ট্র জর্দান কিংবা মিশরে জোর করেই পুনর্বাসিত করা হোক।
ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তকরণ স্থায়ী ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে এই আশংকায় মিশর ও জর্দানসহ আরব রাষ্ট্রগুলি এবং ফিলিস্তিনিরা ট্রাম্পের এই পরামর্শকে প্রত্যাখান করেছে।
গাজার স্বাস্থ্যকর্মীদের হিসেবে সেখানে ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণে অন্তত ৪৭,৩০০ জন প্রাণ হারান, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলে নিহতদের এই সংখ্যার মধ্যে ১৭,০০০ জঙ্গিও রয়েছে।
এই খবরে কিছু তথ্য এপি, এএফপি ও রয়টার্স থেকে পাওয়া।