দু’চোখ ভরা আঁধার। কিন্তু স্বপ্নের আলোতে সে আঁধার দূর করে তারা। আর দশজন শিশুর মতো তারাও কেউ কেউ হতে চায় শিক্ষক, কারো ইচ্ছা মনোবিদ হওয়া। স্বপ্নাতুর এসব শিশুর দেখা মেলে রাজধানীর মিরপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে।
স্কুলটি ১৯৭৭ সাল থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুদের পড়ায়। এটিই দেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য প্রথম আবাসিক হোস্টেলসহ স্কুল। মিশনারি স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রেভারনিকা অ্যান ক্যাম্পবেল। শুরুতে এর নাম ছিল ব্যাপ্টিস্ট সংঘ স্কুল ফর ব্লাইন্ড গার্লস।
২০০৭ সালে সাধারণ শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করে এর নামকরণ করা হয় ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান।
সিনথিয়া ইসলাম (১৬) সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। তিন বছর বয়সে তার চোখে সমস্যা ধরা পড়ে। এক সময় কর্নিয়ার পানি শুকিয়ে সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টিশক্তি হারায় সে। তবে বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নের কথা ভোলেনি সে।
সিনথিয়ার কথায়, “তিন বছর বয়স থেকেই আমার চোখে সমস্যা। সাধারণ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এখন এই স্কুলে আছি। এখানে স্টাইলাস আর রাইটিং ফ্রেমের (ব্রেইল পদ্ধতি) সাহায্যে আমরা পরীক্ষা দিই। আমি বড় হয়ে শিক্ষক হতে চাই।”
আরেক শিক্ষার্থী আনিকা ইবনাত নামিরার (১৪) ছোটবেলা থেকেই চোখে সমস্যা। সে কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার শুরু এই স্কুলে। সপ্তম শ্রেণির এই ছাত্রীর ভাষ্য, “দৃষ্টিশক্তি নেই, সে কারণে আমি কখনোই আক্ষেপ করি না। আমি ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করি। আমাদের কিছু পরীক্ষা লিখিত আবার কিছু মৌখিক হয়। আমি স্পর্শ ফাউডেশনের একজন মেম্বার। আমার দায়িত্ব বইমেলা হলে স্টলে বসে থাকা। এই ফাউন্ডেশন আমাদের বিনামূল্যে ব্রেইল বই দেয়। আমি গান গাইতে ভালোবাসি। আমি মনে করি দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা জীবনের বাধা হতে পারে না।”
এমনই আরেক স্বপ্নাতুর কিশোরী মিতু আক্তার মনিতা (১২)। তার ইচ্ছা বড় হয়ে সাইকোলজিস্ট হওয়া। মিতু বলে, “আমি এক চোখে আবছা আরেকটাতে মোটামুটি দেখি। আমার জন্ম থেকে এ সমস্যা। আমি এখানে হোস্টেলে থাকি। আমি এ বছর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। আমি সাইকোলজিস্ট হতে চাই।”
১৪ বছর বয়সী সাথী মারিয়া স্কুলের হোস্টেলেই থাকে। তার অভিজ্ঞতা, “আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। ছোটবেলায় টাইফয়েড হওয়ার পর থেকেই চোখের সমস্যা শুরু হয়। আমি এখন আবছা দেখতে পাই। চিকিৎসকরা বলেছেন, চোখ পরিবর্তন করলে এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে। আমি দেখতে পারব। আমি গান গাইতে ভালোবাসি। ভবিষ্যতে সঙ্গীতশিল্পী হতে চাই।”
ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী ইন্টিগ্রেটেড স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল লেয়া অন্তরা বাড়ৈ বলেন, “আমাদের স্কুল ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে। আমি ১২ বছর ধরে এ স্কুলের সাথে আছি। আমাদের স্কুল মূলত দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য শুরু হয়েছিল। আমাদের এখানে সাধারণ বাচ্চারাও পড়ে। আমাদের প্রত্যেক শিক্ষককে ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। মোট ছয়টি ডটের মাধ্যমে শিশুদের শেখানো হয় লেখার কাজটা। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের ব্রেইলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে পড়ানো শুরু করা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রথমে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হলেও তারা ঠিকই বন্ধুত্ব করে ফেলে। এখানে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। ছাত্রীদের মাঝে শেখার আগ্রহ অটুট। ”
কথা হয় নাহিদা রহমান নামে এক অভিভাবকের সঙ্গে। তার মেয়ে সিদ্রাতুল মুনতাহা সোফিয়া (৮) এখনও তার দৃষ্টিহীনতার বিষয় প্রতিবন্ধী। নাহিদা বলেন, “আমার মেয়ে এখনও তার প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি বোঝে না। তার ধারণা, সব মানুষই এমন। তবে তার শেখার আগ্রহ অনেক। সে অন্য দশটি শিশুর থেকে বেশি চিন্তাশীল। জন্মের পর থেকেই দৃষ্টিহীন শিশুটি নিজের কাজ নিজেই করতে পারে।”
মুনতাহার মায়ের তার মায়ের চাওয়া, “আমি চাই মেয়ে বড় হয়ে নিজের জন্য কিছু করুক। তার ইচ্ছাশক্তি প্রবল। এই স্কুল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের অনেক খেয়াল রাখে।”
স্কুলটির শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গান, নাচ ইত্যাদি দক্ষতায়ও পারদর্শী।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রিন্সিপাল বলেন, “আমাদের গানের ক্লাস করানো হয়। শিক্ষার্থীরা বেশ আনন্দের সঙ্গে শেখে এবং বেশ ভালো গাইতে পারে।”
এই স্কুলের অনেক সাবেক শিক্ষার্থী এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
এ বিষয়ে ভাইস প্রিন্সিপাল বলেন, “আমাদের মেয়েরা অনেক ভালো ভালো কলেজে লেখাপড়া করছে। আবার অনেক শিক্ষার্থীরা স্নাতক শেষ করেছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় তারা কর্মরত। অনেকে ব্যাংকে চাকরি করছে, একজন আই হসপিটালে কাউন্সিলর হিসেবে আছে। কেউ কেউ বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করছে, অনেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরেও আছে। ওরা ভালো ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। এটা আমাদের অনেক বড় পাওয়া। ”
স্কুলের আরেক শিক্ষক নমিতা হালদার বলেন, “দৃষ্টিহীন শিশুদের প্রথমেই ব্রেইলে লেখা শেখানো হয়। এ সময়টা তাদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে তাদের মাঝে একদম আগ্রহ থাকে না। তাদের মাঝে প্রাণশক্তির সঞ্চার করতে হয়। আর এই দায়িত্বটা আমাদের। শিশুরা একবার শিখে গেলেই উজ্জীবিত হয়ে যায়। আর তখনই তারা ভালো করা শুরু করে। আমাদের প্রায় অর্ধশত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আছে। তাদের নিয়ে আমাদের পথচলা। আমি নিজেও এখানকার সাবেক শিক্ষার্থী হওয়ায় তাদের বিষয়গুলো বেশ ভালো বুঝি।”