সীমান্ত সড়কে বদলে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্যপট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের অংশ হিসেবে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। পাহাড়ি-বাঙালিদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এটি। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপের ৩৭০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কর্মযজ্ঞ চলছে। পাহাড়ি জনপদগুলোতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। পর্যায়ক্রমে ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হবে। পুরো সড়ক নির্মাণ শেষ হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের যেমন প্রসার ঘটবে, তেমনি যোগাযোগব্যবস্থা ও পর্যটনশিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। পুরো পাহাড় এলাকা নিরাপত্তার মধ্যে চলে আসবে। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চল সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করবে।
তবে পাহাড়ের সীমান্তে সড়ক বন্ধ করতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল গত ১০ এপ্রিল গোপন বৈঠক করেছে। বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছেন পার্বত্যাঞ্চলের বিতর্কিত পরিবারের সদস্য, যিনি দেশ-বিদেশে পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন তিনি পাহাড়িদের উসকে দিয়ে সীমান্তের রাস্তার কাজ বন্ধের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। মূলত সড়ক হয়ে গেলে তাদের অবৈধ আয়-রুজি কমে যাবে, চাঁদাবাজি করতে পারবে না। এই পরিবারের দীর্ঘদিনের বিলাসবহুল জীবনের অবসান ঘটবে। অন্যদিকে অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের ব্যবসা নির্বিঘ্নে করতে পারবে না—এসব কারণেই পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্তে সড়ক চায় না ঐ গোষ্ঠী।
পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্তে সড়ক না থাকায় এই দীর্ঘ এলাকা অনেকটাই অরক্ষিত। এই পথ দিয়ে অবাধে আসে দেশের সিংহভাগ অস্ত্র, গ্রেনেড, একে৪৭ রাইফেল, গোলাবারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্রের চালান। একই সঙ্গে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের চালানও আসছে। রাস্তাঘাট ও ব্রিজ না থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে নিয়মিত টহল দিতে পারে না বিধায় অনেকটা বিনা বাধায় ঢুকে পড়ছে অস্ত্র ও মাদক। হাঁটা ছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেতে পারে না। কোনো একটি ঘটনা ঘটলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় গহিন অরণ্যে রয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর বিশাল আস্তানা। চারদিকে খাল। পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র চারটি গ্রুপের মধ্যে একটি এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মূল আস্তানা সেখানেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, তখন সন্ত্রাসীরা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ব্যবসায়ী, পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজনকে অপহরণ করে ঐ আস্তানায় রেখে মুক্তিপণ আদায় করে। অনেককে সেখানে হত্যাও করে। বাইরে থেকে চোরাই পথে আসা অস্ত্র সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় এই দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাস দমন কার্যক্রম অনেকটা হুমকিতে পড়েছে। রাস্তাঘাট ও ব্রিজ করতে গেলে বাধা দেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তাদের বাধার মুখে অনেক সময় উন্নয়নমূলক নির্মাণকাজ করা সম্ভব হয় না। মূলত একটি রাজাকার পরিবারের সদস্যরা চাইছেন না সীমান্তবর্তী এলাকায় সড়ক যোগাযোগ হোক। সড়ক হলে এলাকাটি নিরাপত্তার মধ্যে চলে আসবে। এতে রাজাকার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ আয় কমে যাবে। সড়ক নির্মাণ বন্ধ করতে ঐ রাজাকার পরিবারের সদস্যরাই গোপন বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। তাদের এই অপতত্পরতার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পাহাড়ি-বাঙালিরা। বিতর্কিত ঐ পরিবারের সদস্যরা পাহাড়ের একটি বড় এলাকা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব চাঁদাবাজির নেতৃত্বে রয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের আরও চারটি সংগঠন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। দুর্গম হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে একসময় পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বলা হলেও বর্তমান সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নবযুগের সূচনা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সড়ক যোগাযোগে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্যপট বদলে দিতে বর্তমান সরকার ২০১৯ সালে সীমান্ত সড়ক নির্মাণকাজের সূচনা করে। সীমান্ত সড়ক ঘিরে মানুষ এখন নতুনভাবে স্বপ্ন বুনছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটনশিল্পের প্রসার এবং জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তনে সীমান্ত সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে পাহাড়ি-বাঙালিরা যেমন আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছে, তেমনি বর্তমান সরকারের এমন সাহসী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।
বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের ডুলু বাগান এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘সীমান্ত সড়ক হওয়ায় আমরা অনায়াসে রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রামে দ্রুত যেতে পারব। বিদ্যুৎ পাব, স্কুল-কলেজ হবে। আমরা খুব খুশি।’
একই এলাকার বাসিন্দা বলি চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, একসময় বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নে উৎপাদিত ফসল রাজস্থলী উপজেলা সদরে নিয়ে আসতে তিন দিন সময় লাগত। এখন সীমান্ত সড়ক হয়ে যাওয়ায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কৃষকেরা তাদের ফসল রাজস্থলীতে নিয়ে আসতে পারছেন। এটা সরকারের বড় সফলতা। সীমান্তবর্তী এলাকায় নেটওয়ার্ক নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানির তীব্র সংকট, সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। পুরো সড়কটি হলে এখানে বিদ্যুৎ চলে আসবে, নেটওয়ার্ক সমস্যা থাকবে না, পানির সংকট দূর হয়ে যাবে এবং সন্ত্রাসীও থাকবে না। পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস ফিরে আসবে। পাহাড়ি-বাঙালিদের এক দাবি—সন্ত্রাস নির্মূল করা হোক।
তারা বলেন, সন্ত্রাসের সঙ্গে আমরা বসবাস করতে চাই না। সরকারকে কঠোর হাতে সন্ত্রাসীদের দমন করার আহ্বান জানান তারা।