তাঁর দীর্ঘ রাজনীতির লক্ষ্যই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। আর তাই, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি সশস্ত্র পন্থায়ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তিনি অনুধাবন করেন পাকিস্তান কাঠামোতে বাঙালি জাতির মুক্তি আসবে না। এ লক্ষ্যে তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি সশস্ত্র পন্থায়ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন। বাইরের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন এবং তার গণতান্ত্রিক রূপ অর্থাৎ ‘পিপলস মুভমেন্টের’ সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিকল্প ‘সাবজেকটিভ’ স্ট্রাকচার নির্মাণ করেছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই বাঙালি জাতিস্বত্ত্বা নির্মাণ করে ধীরে ধীরে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ করে তুলেছিলেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই তিনি অনুধাবন করেন পাকিস্তান কাঠামোতে বাঙালি জাতির মুক্তি আসবে না। পশ্চিম পাকিস্তান ও মুসলিম লীগ ক্রমেই আগ্রাসী, ক্ষমতাতান্ত্রিক ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, ফলে, এক নতুন রাজনীতি ও নতুন জাতির জন্য স্বাধীনতা দরকার-এটাই ছিল বৃহত্তর জনতার একান্ত আর্তি।
এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি দু’ভাবেই এগুতে থাকেন। নিয়মতান্ত্রিক ভাবে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি প্রথমে বাঙালি জাতি গঠনের উপর জোর দেন। ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার তীব্র আকাংখা জাগাতে শুরু করেন। অন্যদিকে, বিকল্প সশস্ত্র পন্থার দিকেও নজর দেন।
দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা যে গঠন করা হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণে তাই বলা হয়েছে। আর এই মামলা যে সত্যি ছিল, মামলার আসামিরা তা বলেছেন।
অধ্যাপক সাহাবউদ্দিন খালেদ চৌধুরী যিনি ১৯৬৭ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাঠচক্র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১২নং আসামি চট্টগ্রামের ভূপতিভুষণ (মানিক) চৌধুরীর অনুসারি। তিনি বলেন, ‘১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর যখন রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো, তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ ছাড়া দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই।
এসময় বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১২নং আসামি, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত চট্টগ্রামের ভূপতিভুষণ চৌধুরীর (মানিক চৌধুরী) মাধ্যমে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহেরু। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মানিক চৌধুরী ত্রিপুরা রাজ্যের তৎকালীন কংগ্রেস নেতা শচীন লাল সিংহ (পরে তিনি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন) এর মাধ্যমে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলার সময়ে বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে মানিক চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে আগরতলা হয়ে নয়াদিল্লী যান। প্রয়াত ভূপতিভুষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) জীবদ্দশায় তাকে এ তথ্য জানিয়েছিলেন বলে জানান অধ্যাপক সাহাবউদ্দিন খালেদ চৌধুরী।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ লিখিত ‘আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ’ গ্রন্থে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের বর্ণনাতেও বঙ্গবন্ধুর আগরতলা যাওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করা হয়েছিল।
ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবির মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসন দাবির আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের একাধিক বৈঠকে তিনি কয়েক দফা স্বাধীনতার কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৬১ সালের শেষ দিকে নভেম্বর-ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে পার্টির তৎকালীন নেতা প্রয়াত মনি সিংহ এবং খোকা রায়সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং সংবাদের জহুর হোসেন চেীধুরী ছিলেন এই বৈঠকগুলোর মধ্যস্হতাকারী। আর বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো ‘ভাই সাহেব’ নামে খ্যাত এক ব্যক্তির বাসায়। আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের গাড়িতে করে আনা-নেয়া করতেন এক নারী। তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করতেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব দলিল, পার্টির বিভিন্ন পুস্তক এবং প্রয়াত নেতৃবৃন্দের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে এসব বৈঠকের কথা রয়েছে উল্লেখ করে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বৈঠকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কি কি দাবিতে আন্দোলন করা যায় তা নিয়ে আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথাই বলতেন। ‘একমাত্র স্বাধীনতাই বাঙালির মুক্তি’ এ কথা বঙ্গবন্ধু সব সময় বলে থাকতেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার প্রস্তাবটিকে পার্টির নেতারা ন্যায্য বলে মেনে নিলেও এটিকে ভিত্তি করে আন্দোলন শুরু করার সময় হয়নি বলে মতামত ব্যক্ত করেন। পার্টির নেতারা বলতেন, ‘জনগণকে আগে প্রস্তুত করা দরকার।’
পরপর একাধিক বৈঠকে স্বাধীনতার দাবির কথা উত্থাপন করলেও পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে আন্দেলনের সূচনা করার পরামর্শ দিলে বঙ্গবন্ধু সেই সময় বলেন, ‘দাদা আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম, কিন্তু যুক্তি মানলাম না। আমি স্বাধীন পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) কথাই বলবো।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এ মামলার অন্যতম আসামি কর্নেল (অব.) শওকত আলী তার লেখা ‘আগরতলা মামলার আদ্যোপান্ত’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যারা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম, ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি তাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ, আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম।’
তিনি বলেন, আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব ক’টি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেব, তাদের বন্দী করব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করব।’
শওকত আলীর এই বক্তব্যের সাথে মিল পাওয়া যায় ভারতীয় সাংবাদিক অমিতাভ গুপ্তের বক্তব্যেরও। সাংবাদিক গবেষক লেখক অমিতাভ গুপ্ত ‘গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশ মুক্তি সৈনিক শেখ মুজিব’ গ্রন্থে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই ‘সংস্থা’ গঠনের কথা উল্লেখ করেছেন।
অমিতাভ গুপ্ত এই গ্রন্থে লিখেন, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের আবেগের বেষ্টনী থেকে জনগণকে নির্মোহ করতে হয়েছে। বাইরের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন এবং তার গণতান্ত্রিক রূপ অর্থাৎ ‘পিপলস মুভমেন্টের’ সঙ্গে সংগতি রেখে বিকল্প ‘সাবজেকটিভ’ স্ট্রাকচার শেখ মুজিবকে নির্মাণ করতে হয়েছিল। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন রাওয়ালপিন্ডির কঠোর সামরিক শাসনের মধ্যে কোন ধরনের ‘আন্ডার গ্রাউন্ড মুভমেন্ট বা গুপ্ত আন্দোলন গড়ে তোলা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক দায়িত্ব। কিন্তু, এই প্রচন্ড ঝুঁকির মধ্যেও শেখ মুজিব ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কারাগার থেকে মুক্ত হয়েই আওয়ামী লীগের কিছু বিশ্বস্ত ও দুঃসাহসী কর্মীর প্রতি ‘আন্ডার গ্রাউন্ড সেল’ গঠনের নির্দেশ দেন। তিনি এই গুপ্ত সেলের কর্মীদের সংগ্রামের আদর্শে দীক্ষাও দিয়েছিলেন। সেসময় শেখ মুজিবের প্রথম প্রচেষ্টা ছিল উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলেই আঘাত হানা। গোড়া থেকেই তিনি বিশ্বাস করতেন, পূর্ববঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি পুঁজিপতি ও আমলাতন্ত্রের শাসন ও শোষণ কায়েম হয়েছে এবং বাংলার মাটিতে চলছে পুরোপুরি উপনেবশিক রাজত্ব।
শেখ মুজিব সঠিক বিশ্লেষণ করেছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানি এই নির্মম ও মনুষ্যত্ব বর্জিত ‘কলোনিয়ালিস্ট’দের প্রকৃত পক্ষে কোন জনপ্রিয়তা নেই এবং পাকিস্তানি আর্মির যে শক্তিমত্তা সেটাই পূর্ববঙ্গে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে।
আন্ডারগ্রাউন্ড সেল বা সংগঠনে শুধু তাদেরই সদস্য করা হতো যারা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শে ও বক্তব্যে সম্পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতেন।