আন্দোলন ও নির্বাচন ইস্যু দু’টি নিয়ে দ্বিমুখী চাপে বিএনপি। দলের তৃণমূল ও বিদেশি বন্ধুদের চাপ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার। আর বিএনপির একাংশ ও শরিকদের চাপ আরও কঠোর আন্দোলন করে সরকারকে আরও চাপে ফেলার।
বিএনপি চাইছে তাদের চূড়ান্ত আন্দোলন কর্মসূচির আগে সরকারের ওপর বিদেশিদের চাপ আরও বাড়ুক। এই চাপ বাড়াতে বিএনপি আরও তৎপর হবে। সামনে পাঁচ সিটির নির্বাচনে বিএনপি স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় বাধা দেবে না । দলীয়ভাবে তারা নির্বাচনে যাচ্ছেনা। তবে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে বাধা দেবেনা। হয়তো দল থেকে নৈতিক কারণে বহিষ্কারের চিঠিও দেওয়া হবে, তবে নিরুৎসাহিত করা হবে না।
পাঁচ সিটিতে আগে থেকেই বিএএনপির স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রস্তুত আছেন। সবার আগে আলোচনায় আছেন সিলেটের মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। এদিকে বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করেন সামনের জাতীয় নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলে স্বতন্ত্রভাবে বিএনপির অনেকেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। সরকার আগামী নির্বাচন যেকোনোভাবেই হোক অংশগ্রহণমূলক করতে চায়। বিএনপি নির্বাচনে না গেলে স্বতন্ত্র প্রার্থিতাকে আওয়ামী লীগের দিক থেকে নানাভাবে উৎসাহিত করা হবে বলে তারা মনে করেন। সরকার সিটি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করে বিদেশিদের বার্তা দিতে চায়। তাই বিএনপি সিটি নির্বাচনের সুযোগটি কৌশলে নিলেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের ‘ফাঁদের ব্যাপারে’ সতর্ক অবস্থানে আছে।
আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিএনপির ওপর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চাপ আছে। আর সরকারের ওপর চাপ আছে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রোববার ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন গুরুত্ব পেয়েছে।
জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন মার্কিন দূত। আর সেক্ষেত্রে বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে আবারও তাদের যুক্তি তুলে ধরছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো অবস্থান না নিলেও অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে তাদের আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টার কথা বলেছে।
মার্কিন দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রদূত হাস বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও শামা ওবায়েদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং অহিংস রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা করেন।’
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে যেহেতু মার্কিন দূতাবাস একটি বিবৃতি দিয়েছে তাই আমরা আর কোনো কথা বলতে চাইনা। তারই তো বলেছে।’
“}”>
জানা গেছে, বিএনপি ঈদের পরে আরও কঠোর আন্দোলনে যাবে। তবে সেটা হরতালের চেয়ে আর বেশি কিছু নয়। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর যেমন চাপ আছে, তেমনি আন্দোলনের ধরন নিয়ে বিএনপি তথা বিরোধীদের ওপর চাপ আছে। তাই বিএনপি আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্যে একটা ব্যালেন্স করতে চায়। আর মন্দার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। তাই যদি এমন কোনো আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া হয় যাতে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় তাহলে তা সাধারণ মানুষ ও বিদেশিরা কীভাবে নেবে তাও বিবেচনায় নিচ্ছে বিএনপি।
বিএনপির এখন চলমান কর্মসূচি হলো দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে সভা-সমাবেশ। এটা ঈদের পরও অব্যাহত থাকবে। ঈদের পর শরিক ও সমমনা দলগুলো নিয়ে তারা যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে চায়। বিএনপির সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলনে আছে তাদের অধিকাংশই মনে করে প্রচলিত সভা-সমাবেশে স্টাইলের আন্দোলন আর চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়ার কিছু নেই। এখন হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে। বিএনপি চাইছে ঈদের পর তৃণমূল পর্যায়ে আরও আন্দোলন জোরদার করে শেষ দিকে এসে ঢাকায় কঠোর কর্মসূচি দিতে।
বিএনপি এই সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ আরও বাড়িয়ে সরকারের ওপর আরও বড় চাপ সৃষ্টি করতে চায়। বিভিন্ন দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক প্রেসার গ্রুপের কাছে তাদের বক্তব্য হলো, ‘আমরা গণতান্ত্রিক রীতি বজায় রেখেই আন্দোলন করব। তবে সরকারকেও গণতান্ত্রিক আচরণ করতে হবে।’
গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যেতে হবে। আমরা যারা যুগপৎ আন্দোলন করছি তারা অভিন্ন দাবি ও কর্মসূচি নিয়ে আসছি।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘আমরা ১০ দফার আন্দোলন করছি। তৃণমূল পর্যন্ত দেশের জনগণ এতে ব্যাপক সাড়া দিয়েছে। এখন জনগণের আকাঙ্ক্ষা হলো এই সরকারের বিদায় এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমরা অবশ্যই আরও কঠোর কর্মসূচি দেব। রোজার মাসেও আমরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছি। আমরা চূড়ান্ত আন্দোলনের সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে আন্দোলনের পরবর্তী ধাপের কর্মসূচি খুব দ্রুতই ঘোষণা করব।’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলন চলছে। তবে আন্দোলনের একটি যৌথ কর্মসূচি ও আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। আমরা এখন একটি টার্নিং পয়েন্টে আছি। শিগগিরই আমরা একটি যৌথ কর্মসূচিতে যাব।’
নির্বাচনের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা এই সরকারের অধীনে কোনো ধরনের নির্বাচনেই অংশ নেবোনা। কেউ যদি সিটি নির্বাচনে অংশ নেয় তাকে বহিষ্কার করা হবে। তারপর স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে আমাদের তোর আর কিছু বলার থাকবেনা।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগী ও বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের যে আলোচনা হচ্ছে এটা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই আলোচনা চলবে।’
তার কথা, ‘আমরা আলোচনা করলে সরকার বলে আমরা ধারণা দিচ্ছি। তাহলে তারা আলোচনা করলে সেটা কী বলবেন। আমরা যাদের সঙ্গে কথা বলি তারাও তো তাদের সঙ্গেই কথা বলছেন। আমরা যেখানে মিটিং করি তারাও তো সেখানে মিটিং করেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আন্দোলনকেও চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবো। তবে এটা ঠিক কখন হবে তা বলা সম্ভব নয়। চূড়ান্ত আন্দোলন আগে থেকে বলে কয়ে সম্ভব না।’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। এখন সিটি নির্বাচনে কেউ স্বতন্ত্র অংশ নিলে সেটা তাদের ব্যাপার। আমরা এ ব্যাপারে কিছু জানিনা।’
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।