কাজল শাহনেওয়াজ আমাদের শৈশবে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বেশ মাতামাতি ছিল, প্রতি বছর নজরুলজয়ন্তী হতো তার জন্মদিনে, ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর পর মৃত্যু দিবসও পালন করা হতো। স্কুল কলেজে তার কবিতা আবৃত্তি হতো, একক অভিনয় হতো কবিতার, সভা করে সামাজিক জীবনে নজরুলের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হতো। এগুলো হতো শুধু প্রধান শহরে নয়, ছোট ছোট শহরে, উপজেলায়, ইউনিয়নে, গ্রামে সর্বত্র! তখন প্রতিটা শিশু তাকে চিনত, তার কবিতা মুখস্থ করত, কেউ কেউ বড় হয়ে কবি নজরুল হতে চাইত!
তারপর অনেক কিছুর মতো এই চিত্রটা দেশ থেকে হারিয়ে গেল। নজরুল দেশের জাতীয় কবি হয়ে রইলেন, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে লুপ্ত হয়ে গেলেন।
গ্রীষ্মের কবি আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। এই জ্যৈষ্ঠ মাসে তার জন্ম। তার কবিতা-প্রাণ ফলের রসে রঙিন, গান সুরে সুরে মন প্রাণ-খোলা, গদ্য ভোলাভালা রাজনৈতিক। আমাদের নজরুল আমাদের জাতীয় চরিত্রের পরিচায়ক যেন তাকে সামনে রেখেই রচিত হয়েছে আমাদের সব বাঙালিয়ানা।
আবার নজরুল একজন আহত আলফা মন। প্রবল পুরুষের হারিয়ে যাওয়া।
রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের দুই কবি নজরুল ও জীবনানন্দের মধ্যে অনেক মিল ও অমিল। একই সালে জন্ম (১৮৯৯) কিন্তু বিস্তর দুইরকম ফারাক এই দুই কবির। মিল আছে জীবন বৃত্তে একজন অকালে চিরজীবনের জন্য রুগ্ণ হয়ে গেলেন (নজরুল ৪৩ বছর বয়সে) আর জীবনানন্দ অকালে আঘাতে মারা গেলেন (৫৪ বছর বয়সে)। দুজনেরই সক্রিয় জীবনে অকালে সাহিত্যচ্ছেদ হলেও, তাদের বেশিরভাগ বই প্রকাশিত হলো পরে। একজন মানুষের মনকে জাগিয়ে তোলার জন্য লিখলেন, আরেকজন মানুষের বৈদগ্ধকে উন্মোচিত করলেন কবিতায়, গদ্যে।
বাংলা ভাষার নয়নের মণি এই দুই কবির জীবন কতই না বিপরীত। নজরুল অল্প বয়সেই বই করেন, ২৩ বছর বয়সে। আর জীবনানন্দ ২৭ বছর বয়সে, তাও তার প্রথম বইটাকে (‘ঝরাপালক’) অনেকে মনে করেন তাতে নজরুলের কবিতার ছাপ রয়েছে।
নজরুল ছিলেন সুপার সাইক্লোন। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে ঝড়ের গতিতে রচনা করে গেছেন। অনেক কিছু রচনা করলেও তিনি ছিলেন মূলত কবি। কবি, যে কিনা মানুষের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করেন, ধর্মের সঙ্গে ধর্মকে, জাতির সঙ্গে জাতিকে। গদ্যের সঙ্গে সুরকে, ধ্বনির সঙ্গে উপমাকে, রাজনীতির সঙ্গে চিত্রকল্পকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে যুদ্ধ-রেডিও হয়েছিল, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, সেখান থেকে একটা গান বাজানো হতো, তাতে বাংলাদেশকে বিবৃত করা হতো:
বিশ্বকবির ‘সোনার বাংলা’, নজরুলের ‘বাংলাদেশ’, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’- রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ!
এই গানটায় বাংলাদেশকে বর্ণনা করতে গিয়ে রঙের তালিকার মধ্যে নজরুলকে পুরো দেশটাই দেওয়া হয়েছে। যেন যেহেতু দেশ স্বাধীন হয়েছে যুদ্ধ করে তাই যুদ্ধটা নজরুলের একান্ত বিষয়। যুদ্ধ নিয়ে আর কেউ লেখেননি।
সারা জীবন অসংখ্য বিদেশি ভাষা ব্যবহার করেছেন। বাংলার বাইরে গেছেন করাচি পর্যন্ত, কিন্ত তার ভাষার ব্যবহারে মনে হয় তিনি অনেক দিন বাস করেছেন আরবি, ফার্সি, তুর্কি, ইংরেজি, পশতু, উর্দু এইসব ভাষার পরিমণ্ডলে। তার কাছে শিখতে হবে বিদেশি ভাষা ব্যবহারের টেকনিক। যৌথ সমাজের ভাষা-সমাজের বিভিন্ন পেশা, গোত্র ও অঞ্চলের ভাষারূপের স্মার্ট ব্যবহার শিখতে হবে নজরুলের কাছ থেকে।
নজরুলের গান নতুন আয়োজনে সমকালীন সুরে গাওয়া যেতে পারে। কে গাইবে তা, তার জন্য অপেক্ষা আমার।
নজরুল লেখেন দেশের মানুষের মনের ভেতরের অনেক না বলা আবেগ, না বলা বেদনা। উন্মোচিত করেছেন সাধারণ মনের কথাগুলোকে, ভাষা দিয়েছেন। এজন্য তার সাহিত্য সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে খুব গভীরে কাজ করেছে। প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে থেকে গেছে। সবার যৌথমনের ভেতরে কাজ করেছেন নজরুল।
শিশুদের যেভাবে ভালোবেসেছিলেন এমন করে কেউ আর ভালোবাসেনি। কল্পনায়, ছন্দ-দোলায় আর শব্দ মিলে শিশুদের জন্য তিনি রচনা করেছেন এখনকার যুগের শিক্ষা মনস্তত্ত্ববিদ শিশুকে যেভাবে পালন করতে বলেন। তার কবিতা পড়েই একজন শিশু মানুষের জীবনকে ভালোবাসা শিখতে পারবে, এককজন শিশু তার পোষাপ্রাণী বা বাসার পাশের গাছকে ভালোবাসতে পারবে। আমাদের শিশুদের জন্য নজরুলকে খুব দরকার।
নজরুল বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন:
করি শত্রুর সাথে গলাগলি,
ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
লিখেছেন:
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী
আর হাতে রণ-তূর্য
যখন একে একে খসে পড়ে যাচ্ছে আমাদের সব মূল্যবোধ, মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে তাতে কাজী নজরুল ইসলাম খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছেন এখন। কারণ উনি ছিলেন জাতির জোড়া লাগানো কাজে ওস্তাদ কবি।
এমন এক আধুনিক মন তার, যুদ্ধের বাজনার মধ্যে কবিতা লিখতে গিয়ে লেখেন:
‘দেখচ্ কি দোস্ত অমন করে? হৌ হৌ হৌ
সত্যি তো ভাই!-সন্ধ্যেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ’
(কামাল পাশা)
অথবা
‘ডাবের শীতল জল দিয়ে
মুখ মাজো কি আর প্রিয়ে?’
(ছায়ানট: চৈতী হাওয়া)
তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। প্রায় একশো বছর পরেও দেখি তার কবিতার ভাষা এখনো ঝকঝকে, সপ্রতিভ।
প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় রিকশাওয়ালার সঙ্গে এই ঘটনা ঘটছে। ‘দেখিনু সেদিন রেলে, কুলী বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে! চোখ ফেটে এল জল, এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
সেমিনারে শুনছি গবেষক বলছেন: ‘পুরুষ হৃদয়হীন, মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।’
টকশোতে শুনছি: ‘অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!’
এমন অসংখ্য মণি-মুক্তা ছড়ানো রয়েছে তার কবিতায়।
কী করা যায়?
দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক বিভেদ থেকে বের হওয়ার জন্য এই কাজটা করা যায়।
রুচির দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি দিতে নজরুল চর্চাকে নিয়ে নিম্নলিখিত কাজগুলো করা যায় –
নজরুলের গানগুলো নতুন নতুন ভাবে গাওয়া। তার কবিতার বই ‘ছায়ানট’ নামের প্রতিষ্ঠানে নজরুল চর্চা বাড়িয়ে দেওয়া।
নতুন করে নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করা। সারা দেশে স্কুলে-কলেজে আবৃত্তি ছড়িয়ে দেওয়া।
গণমাধ্যম, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে নজরুলের টেক্সট ব্যবহারে উদ্দীপিত করতে হবে যাতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নজরুল নিয়ে যথার্থ মনোযোগ তৈরি হয়।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়কে নজরুল নিবেদিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমকালে নজরুল উপযোগিতা বাড়ানোর গবেষণা করতে হবে।
জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলকে যথাযথ মর্মার্থে সরকার ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
ইরান যেমন কবি ফেরদৌসীকে নিয়ে জাতীয় দিবস উদযাপন করে, আমরাও নজরুলকে নিয়ে জাতীয় দিবস পালন করতে পারি। ব্রিটেন যেভাবে শেক্সপিয়ারকে নিয়ে, পশ্চিমবঙ্গ যেভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিদিনের জীবনযাপনের অংশ করে রেখেছে সেভাবে নজরুলকে নিয়ে আসতে পারি
নজরুলকে নিয়ে টিকটক, ইউটিউব, ফেসবুক কন্টেন্ট ক্রিয়েট করতে হবে
গ্রামে-গঞ্জে যে সব জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আছে যেমন হিরো আলম-তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে নজরুল বিষয়ে গুরুত্ব বোঝাতে হবে। তাদের দিয়ে কন্টেন্ট বানাতে হবে। তাদেরকে নিয়ে পুরস্কার প্রতিযোগিতা করতে হবে
নজরুলকে নিয়ে চর্চা করলে পুরস্কার, না করলে তিরস্কার করতে হবে।
বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাদুঘর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সবার প্রধান কাজ হবে ৫ বছরব্যাপী নজরুলচর্চা। তারপর রিভিউ করে আবার ৫ বছরের পরিকল্পনা।
সারা দেশে নজরুলের ভাস্কর্য চাই। নজরুলের উপমা, চিত্রকল্প আর ছন্দের পথ ধরে ভাষার উৎসবে ভরে দিতে হবে সারা দেশ।
এই কাজগুলো করার জন্য দেশের প্রমাণিত নজরুল গবেষকদের সক্রিয় হতে হবে। তাদের পরামর্শে ও উদ্যোগে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। তবে এজন্য অবশ্যই অনেক ধরনের তরুণ গবেষক ও অ্যাকটিভিস্টদের সহায়তা নিতে হবে। দেশ-বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের ছাড়া এ কাজ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে আমাদের লক্ষ্য হবে তরুণ প্রজন্ম, যারা নজরুলকে প্রায় কিছুই জানে না। তারা নজরুলের গান শোনেনি, নজরুলের কবিতা পড়েনি কোনো দিন।
নজরুল জন্মশতবর্ষ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এবার তার প্রতিটা জন্মদিন থেকে শুরু করতে পারি নজরুল পুনর্নির্মাণ। তাহলেই হয়তো যে সাংস্কৃতিক রুচির দুর্ভিক্ষ হয়েছে বলা হচ্ছে, তা থেকে মুক্ত হতে পারব।
কবি ও গল্পকার