কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, ওই অগ্নিকাণ্ডে নয় হাজারের বেশি ঘর পুড়ে প্রায় ৪৫ হাজার শরণার্থী বাসস্থান হারিয়েছেন।
মঙ্গলবার বিকেলে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সন্মেলনে এসব তথ্য জানান দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসিন।
তবে ওই অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জন মারা গেছেন এবং অন্তত আরো ৫৬০ জন আহত হয়েছেন বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানায় জাতিসংঘের শরণার্থী–বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথভাবে সহায়ক সংস্থাগুলো সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বলেও বিবৃতিতে জানায় ইউএনএইচসিআর।
এদিকে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত এনজিওদের সমন্বয়কারী সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) দাবি করেছে, অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজার ঘর পুড়ে গেছে এবং এখনো প্রায় চারশো মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।
নিখোঁজদের সন্ধানে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
“আমরা রোহিঙ্গা মাঝিদের কাছ থেকে শিশুদের নিখোঁজ থাকার খবর পাচ্ছি। ফলে আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছি। এতে স্থানীয় লোকজন সহায়তা করছে,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন কক্সবাজার ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাহদাত হোসেন।
“উদ্ধার হওয়া লাশগুলো পুলিশকে হস্তান্তর করা হয়েছে,” জানান তিনি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া শিশুদের সন্ধানে উখিয়া বালুখালী শিবিরে একটি বুথ বসিয়েছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক।
বুথের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. সোহেল রানা বেনারকে জানান, “আমরা বিকেল পর্যন্ত দেড়শ শিশু নিখোঁজ থাকার খবর পেয়েছি। তার মধ্যে তিন শিশুকে খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি।”
সোমবার বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে উখিয়ার বালুখালী শরণার্থী শিবিরে আগুন লাগে। এর পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ প্রায় আট ঘণ্টার চেষ্টায় রাত সোয়া ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত পোড়া ধ্বংসস্তূপে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে জানিয়ে শাহদাত হোসেন বলেন “আমরা এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”
পুলিশের তথ্যমতে, অগ্নিকাণ্ডে নিহতরা হলেন; বালুখালী নয় নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের সলিম উল্লাহ (৫৫), রফিক আলম (২৫), বশির আহমেদ (৬৫), খদিজা বেগম (৭০)।
নিহত তিন শিশুর মধ্যে রয়েছে আব্দুল্লাহ (৮), মিজান মাঝির মেয়ে আসমাউল (৭), আট নম্বর ক্যাম্পের মো. আইয়ুবের ছেলে মিজান (৪)।
বাকি চারজনের নাম-পরিচয় এখন পর্যন্ত জানা যায়নি বলে জানিয়েছে কর্মকর্তারা।
শরণার্থী শিবিরে ‘সবচেয়ে বড়ো অগ্নিকাণ্ড’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বেনারকে জানান, অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানের জন্য শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াতকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি জানিয়ে কমিটির প্রধান শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “এটি স্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ড নাকি নাশকতা, তা তদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
কমিটি বুধবার থেকে কাজ শুরু করবে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এটি এখন পর্যন্ত “সবচেয়ে বড়ো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা,” উল্লেখ করে অতিরিক্ত আরআরআরসি সামছু দ্দৌজা নয়ন বেনারকে বলেন, “ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ কাজ করছে।”
শরণার্থী শিবিরের এই অগ্নিকাণ্ডকে “ভয়াবহ ধাক্কা” হিসেবে উল্লেখ করে মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক এন্টোনিও ভিটোরিনো বলেন, “পুনর্বাসনের জন্য শূন্য থেকে শুরু করতে হবে।”
“আমরা বাংলাদেশ সরকার, আমাদের দাতাগোষ্ঠী, সহযোগী সংস্থা এবং মানবিক সহায়তাকারী সংস্থাগুলোর সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপদ আশ্রয় ফিরিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,” বলেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, সোমবারের ঘটনাসহ শরণার্থী শিবিরে এ বছর মোট পাঁচটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি অগ্নিকাণ্ডে টেকনাফের উনচিপ্রাং শিবিরে ২১টি ও উখিয়ার লম্বাশিয়া শিবিরে ১২টি ঘর আগুনে পুড়ে যায়।
এর আগে ১৪ জানুয়ারি টেকনাফের নয়াপাড়ায় এক অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ শতাধিক এবং ৩ জানুয়ারি একই উপজেলার লেদা ক্যাম্পে আগুন লেগে পুড়ে যায় ৬টি ঘর।
‘রোহিঙ্গাদের কষ্টের দিন’
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডের পর মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী শিশু ও পুরুষ খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। খাদ্য ও পানির সংকট চরমে পৌঁছেছে।
বালুখালীর আট নম্বর ক্যাম্পের বি ২৩ নম্বর ব্লকের রোহিঙ্গা নারী দিলাংকিছ বেগম বেনারকে বলেন, “এক বছর বয়সী এক ছেলে ও তিন বছর বয়সী এক মেয়ে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আছি। সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব, তার ওপর অসহ্য গরম।”
“আগুন লাগার পর থেকে বাচ্চাদের বাবা নিখোঁজ। বাচ্চারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। কিন্তু খাবার দিতে পারছি না,” বলেন তিনি।
অগ্নিকাণ্ডে ছোট বোনকে হারিয়ে হতবিহবল রোহিঙ্গা নুর কামাল বেনারকে বলেন, “আগুন লাগার পর দৌড় ঝাঁপের সময় আমার বোন আম্মুনি (৬) ঘর থেকে বের হয়ে নানার ঘরের দিকে চলে যায়। কিন্তু সেখানে তাঁদের কাউকে না পেয়ে বের হতেই পুড়ে মারা যায়।”
উখিয়া বালুখালী ৯ নম্বর শিবিরের নুরুল হাই পোড়া ঘরের মাটিতে বসে কাঁদতে কাঁদতে বেনারকে জানান, “কাল আগুন লাগার খবর পেয়ে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এরপর থেকে আট বছর বয়সী ছেলে করিম উল্লাহকে আর খুঁজে পাইনি। জানি না সে বেঁচে আছে কিনা।”
আগুনে আমাদের সহায় সম্বল সব শেষ করে দিয়েছে উল্লেখ করে নুরুল হাই জানান, কাল থেকে চোখে ঘুম নেই। পুরো রাত রাস্তায় বসে ছিলাম। আসলে রোহিঙ্গাদের কষ্টের দিন শেষ হবে না।”
উখিয়া বালুখালী ৯ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা সুলতান আহমদ বলেন, খাবার নেই, পানি নেই, থাকার ঘর নেই। এত লোক এখন যাবে কোথায়?
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। এর আগে থেকেও বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
বর্তমানে নতুন-পুরনো মিলে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরের বসবাস করছেন।
নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে নিজেদের দেশ মিয়ানমারে ফিরতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বহু বছর ধরে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে শোচনীয় অবস্থায় বসবাস করা রোহিঙ্গাদের জন্য এই অগ্নিকাণ্ড একটি “ধ্বংসাত্মক আঘাত” বলে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস।
ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন জেসমিন পাপড়ি।