Skip to content

মেস্তা ও পাটশাক গবেষণার নতুন দিগন্ত

চাষাবাদ

মেস্তা ও পাটশাক গবেষণার নতুন দিগন্ত

পাট বাংলাদেশের প্রধান ও অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলার সেনালি আঁশ বলে পরিচিত পাটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যার ধারক ও বাহক এ দেশের জনগণ এবং বাংলাদেশের প্রাচীনতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই)। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবৎকালে ৫৬টি পাট (দেশি ও তোষা), কেনাফ, মেস্তা ও পাটশাকের জাত উদ্ভাবন করেছে। বিজেআরআই উদ্ভাবিত এসব জাতের মধ্যে অনেকগুলো জাতই কৃষকপর্যায়ে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং পাট উৎপাদনকারী এলাকায় ব্যাপকভাব চাষাবাদ হচ্ছে। বিজেআরআই শুধু পাটের কৃষি গবেষণায় সীমাবদ্ধ নয়, এ প্রতিষ্ঠানের আছে শিল্প ও কারিগরি গবেষণা নামে আরো দুটি শাখা। শিল্প ও কারিগরি গবেষণার মাধ্যমে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করে দেশের অনেক ক্ষদ্র্র ও কুটিরশিল্প বাঁচিয়ে রেখেছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে এ দেশের হাজারো বেকার যুবক ও যুবতীর। বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত পাট ও পাটশিল্প, যার পুরোটাই এ দেশের সম্পদ। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে যেমন চিনিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, ঠিক তেমনি পরিচিতি দিয়েছে পাট ও পাটজাত পণ্য। বিজেআরআই উদ্ভাবিত পাট ও সমগোত্রীয় ফসল নিজস্ব তত্ত্বাবধানে একদল নিরলস বিজ্ঞানী সর্বদা গবেষণা করে স্থান উপযোগী ও অঞ্চলভিত্তিক জাত উদ্ভাবন করেছেন। সব পাট উৎপাদনকারী এলাকার জন্য সব জাত সমানভাবে উপযোগী নয়। স্থান উপযোগী ও অঞ্চলভিত্তিক জাত উন্নয়নই গবেষণার মূল ভিত্তি। এ ছাড়া পাট ফসলকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন নতুন শস্যবিন্যাস উদ্ভাবন ও কৃষকপর্যায়ে জনপ্রিয়করণ করাটা বিজেআরআইয়ের গবেষণার অন্যতম মূল মন্ত্র।

পাটের আদি বা উৎপত্তি স্থান হিসেবে ভারত-বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পাটের উৎপত্তিস্থান অবিভক্ত ভারতবর্ষ। ব্রিটিশ শাসনামলে এ দেশ থেকে প্রথম পাট রপ্তানি শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডের ডান্ডিতে এক হাজার টন কাঁচা পাট রপ্তানি হয়। এরপর ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয়ে স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী ধাপ পেরিয়ে মূলধারার গবেষণা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু নির্দেশনা দেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনঃগঠনে জুট মিলগুলো চালু করার। এ ভগ্নদশার জুট মিল চালু করার নির্দেশনা থেকে বোঝা যায় পাটের প্রতি জাতির পিতার ভালোবাসা। একইভাবে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ও বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাটের প্রতি গুরুত্ব¡ ও আগ্রহ একই সূত্রে গাঁথা। প্রধানমন্ত্রী পাটের প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ দেখে দেশের একজন পাট গবেষক হিসেবে নিজকে খুবই গর্বিত মনে হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে পাটের শাড়ি পরিধান করেন এবং পাটের ব্যাগ ব্যবহার করেন। সরকারের স্বদিচ্ছা ও বিজেআরআইয়ের একজন সুযোগ্য ও কর্মঠ মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল আউয়াল নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন কৃষি, কারিগরি ও শিল্প গবেষণা নিয়ে। বিজেআরআই উদ্ভাবিত পাট ও সমগোত্রীয় ফসলকে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে বর্তমান মহাপরিচালক নানামুখী বাস্তব ও সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিন পার্বত্য জেলায় মেস্তা ও পাটশাক ফসলকে জনপ্রিয় করার জন্য কৃষি বনায়নের মধ্যে (ফল বাগানের মধ্যে) ও সবজিখেতে মিশ্র বা সাথি ফসল হিসেবে চাষাবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান মহাপরিচালকের একক প্রচেষ্টার ফলে এক বছরের মধ্যে তিনি ১৯৫১ সালে স্থাপিত বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এ ছাড়া বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার পাটের কৃষি, কারিগরি ও শিল্প গবেষণায় যুগোপযোগী নানামুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ‘ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়নে নতুন নতুন গবেষণা ক্ষেত্র তৈরির তাগিদ দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ‘ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়নের জন্য ৬টি হটস্পট ঘোষণা করেছেন। হটস্পটসমূহ হলো- ১. উপকূলীয় অঞ্চল, ২. বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, ৩. হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, ৪. পার্বত্য অঞ্চল, ৫. নদী ও চরাঞ্চল এলাকা ও ৬. নগর অঞ্চল, সরকার ঘোষিত এ ছয়টি হটস্পটের মধ্যে অন্যতম একটি হলো পার্বত্য এলাকা। বাংলার ভূস্বর্গ বলে পরিচিত তিনটি পার্বত্য জেলা (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান), যার আয়তন ১৩,২৯৫ বর্গ কিমি, যা বাংলাদেশের আয়তনের ৯ শতাংশ। ঐতিহ্যগতভাবে তিন পার্বত্য জেলা কৃষিপণ্যের বা ফল-ফসলের একটি বিশেষ অঞ্চল। সব ধরনের কৃষি ফসল এ অঞ্চলে জন্মানো সম্ভব, কেননা এখানকার মাটি খুবই উর্বর, সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু বৃষ্টির পানি পাহাড়ের গায়ে আটকে থাকে না। এক অপরূপ সুন্দর ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে বিরাজমান। যেকোনো কৃষিপণ্য বা ফসল এখানে বিনা চাষে জন্মানো হয়, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ঝুমচাষ। পুরোপুরি বৃষ্টিনির্ভর ও কৃত্রিম সার ছাড়া, উৎপাদিত যেকোনো ফসল এবং সবজি, গুণে-মানে ও পুষ্টিতে অনন্য। এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় একটা অংশ উপজাতি সম্প্রদায়ের। উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন জীবনমান ও খাদ্যাভ্যাস একটু ভিন্ন ধরনের। উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন জীবনযাপনে ও খাবার গ্রহণে পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর। শাকসবজি ও টকজাতীয় খাবার তাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার প্রধান উপাদান। পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায়ের প্রধান একটি খাদ্য উপাদান হলো মেস্তাপাতা ও মেস্তার ফল, যা স্থানীয় ?উপজাতি সম্প্রদায়ের কাছে খড়পাতা বা খড়াপাতা বা আমিলাপাতা নামে পরিচিত। এ পাতাকে তারা সারা বছর ধরে শাক হিসেবে রান্না করে খায়, কাঁচা ফল-সবজি হিসেবে রান্না করে খায় ও ফল পাকার পরে শুকিয়ে রেখে সারা বছর বিভিন্ন সবজি ও মাছের সঙ্গে মিশ্রণ করে রান্না করে খায়। উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন খুব যত্ন করে নিজ বাড়ির আঙিনায় বা ঘরের সামনে একক ফসল হিসেবে বা সবজি বাগানে মিশ্র ফসল বা সাথি ফসল হিসেবে চাষ করে থাকেন। উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন বিশ্বাস করেন এ গাছটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিশেষ এক ধরনের খাদ্য, যা খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে ও মানুষ সুস্থ থাকে। পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্য অন্য একটি বিশেষ খাদ্যবস্তু হলো পাটশাক, যা স্থানীয়ভাবে ন্যাড়াপাতা বা ন্যাড়াশাক নামে পরিচিত, যা মূলত পাটশাক। পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনও ন্যাড়াপাতা/শাক বা পাটশাক খেয়ে থাকেন। তাদের ভাষ্যমতে, পাটশাক খেলে পেট পরিষ্কার হয় ও পুষ্টিগুণ অন্য শাকের তুলনায় বেশি। এ ফসলটিও এ অঞ্চলে প্রত্যেকটি মানুষের বাড়ির আঙিনায় বা সবজিখেতে একক মিশ্র ফসল/সাথি ফসল হিসেবে চাষাবাদ হয়। স্থানীয় জাত বিধায় এ শাকের রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য শাকের তুলনায় অনেক বেশি। স্থানীয় জাত বিধায় পাহাড়ের যেকোনো মাটিতে জন্মানো সম্ভব। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাট, কেনাফ, মেস্তা ও পাটশাক নিয়ে গবেষণা করে। তাই গবেষণা জোরদারকরণে উপযোগী নতুন নতুন এলাকাকে চাষের আওতায় আনতে এবং সরকার ঘোষিত ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে আরো অধিক এলাকাকে আওতায় আনতে যে পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, এসবের সফল বাস্তবায়নে তিন পার্বত্য জেলা (খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি) হতে পারে বিজেআরআইয়ের নতুন গবেষণার স্থান। এ তিন পার্বত্য জেলা বা উপজেলা পর্যায় অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে। বিজেআরআইয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু ভিন্ন, যেহেতু পাট এমন একটি ফসল, যা যেকোনো স্থানে জন্মানো সম্ভব। কিন্তু পাটকে সরাসরি প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো সুযোগ নেই, প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রধান উপাদান হলো পানি। পাটকে পচাতে হয় এবং এ পচনের মাধ্যমে কাঠি থেকে আঁশ ছড়ানো হয়। এখানে যেহেতু পানির স্বল্পতা, তাই পাট নিয়ে এখানে সরাসরি গবেষণা বিষয়ে কখনো চিন্তা করা হয়নি। পাট ও সমগোত্রীয় ফসলের মধ্যে মেস্তা ও পাটশাক বিজেআরআইর উদ্ভাবিত দুটি ভিন্ন ফসল। যার মধ্যে মেস্তার ফল ও পাতা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় এবং চাইলে গাছ থেকে আঁশও সংগ্রহ করা সম্ভব। অন্যপক্ষে বিজেআরআই উদ্ভাবিত পাটশাক শুধু শাকের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছে। যার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২ ফুট এবং গাছে প্রচুর পাতা (বুশি) থাকে, এই পাটের শাক দেশীয় প্রজাতির হলেও এর স্বাদ মিষ্টি এবং রান্নার পরে এটি খড়খড়া (অন্য পাটশাকের মতো আঠালো ভাব থাকে না) থাকে (সাধারণ পাটপাতা রান্নার পরে পিচ্ছিল হয়)। বর্তমান সরকার ও বিজেআরআইয়ের সুযোগ্য মহাপরিচালকের নির্দেশনায় নতুন স্থান ও বহুমুখী গবেষণার নতুন দিগন্ত খুঁজে পেতে কৃষি বনায়ন পরিবেশে ফল বাগানে ও সবজি বাগানে একক সাথি বা মিশ্র ফসল হিসেবে পাটশাক ও সবজি মেস্তার সম্ভাব্য স্থান খুঁজতে আট দিনের সফরে গিয়েছিলাম বান্দরবন ও রাঙামাটি জেলায়। রাঙামাটি ও বান্দরবানে ভ্রমণে নতুন অনেক অভিজ্ঞতা পেলাম। প্রাকৃতিকভাবেই এখানকার মানুষ স্থানীয় মেস্তা ও পাটশাক উৎপাদন করে বিক্রি করে ও ভক্ষণ করে। স্থানীয় লোকজন জানালেন তারা উচ্চফলনশীল জাত পেলে সহজেই গ্রহণ করবেন এবং চাষে তাদের আগ্রহ আছে। পরিশেষে বলা যায়, সরকার ঘোষিত ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নে বাংলার ভূস্বর্গ বলে পরিচিত তিন পার্বত্য জেলা থেকে পারে বিজেআরআইয়ের নতুন গবেষণার স্থান, যা খুলে দিতে পারে বিজেআরআইয়ের গবেষণার নতুন দিগন্ত এবং আগামী অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা।

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, জুট ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ বিজেআরআই, ঢাকা-১২০৭

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন



বার্তা সূত্র