পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহত হওয়ার ঘটনায় রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন করে শুরু হয়েছে পরষ্পরবিরোধী অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ।
মুখ্যমন্ত্রী কীভাবে আহত হলেন সে বিষয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে নির্বাচন কমিশন।
মমতার আহত হওয়ার ঘটনায় বাকবিতণ্ডা ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্নস্থানে বিরোধী ভারতীয় জনতা পার্টি ও শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের মধ্যে গত দুই দিনে হাতাহাতির বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
বুধবার সন্ধ্যায় নন্দীগ্রামে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তাঁর গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসংযোগের কাজ করছিলেন তখনই গাড়ির দরজার প্রচণ্ড ধাক্কায় তিনি আহত হন।
তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর ওপর পরিকল্পিত হামলার অভিযোগ করে মমতা বলেন, গাড়ির দরজায় কয়েকজন মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেয়।
বুধবার রাতেই মমতাকে কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “মুখ্যমন্ত্রীর গোড়ালিতে ব্যথা রয়েছে। তাঁর পায়ের হাড়ে চোট ধরা পড়ায় প্লাস্টার করা হয়েছে।”
‘‘মুখ্যমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল” রয়েছে জানিয়ে হাসপাতালের অধ্যক্ষ মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর আরো কিছু পরীক্ষা করা হবে।
সাংবাদিকদের কাছে এই ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দাবি করেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য্য। কারা এই ঘটনার পেছনে রয়েছে তাঁদের চিহ্নিত করে শাস্তিও দাবি করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে ওই ঘটনার তদন্ত ও ভিডিও ফুটেজ প্রকাশের দাবি জানায় বিজেপি।
নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে ফিরে এসে বিজেপি নেতা সব্যসাচী দত্ত বেনারকে বলেন, ‘‘ঘটনার সময় তোলা ভিডিও ক্লিপিং অবিলম্বে প্রকাশ করা হোক।”
তিনি বলেন, “যে সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই ঘটনা ঘটে, তখন অনেক সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর নিজের লোকেরাও ছিলেন। তাঁদের ও সংবাদ মাধ্যমের তোলা সব ফুটেজ প্রকাশ করা হোক।”
বিজেপি নেতারা যাবার আগেই তৃণমূল কংগ্রেসের এক প্রতিনিধিদলও নির্বাচন কমিশনে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করে।
মমতার ওপর আক্রমণের দায় কার–সেই প্রশ্ন তুলেছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
‘হুইল চেয়ারেই প্রচার’
বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে এক ভিডিও বার্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, তিনি হুইল চেয়ারে বসেই নির্বাচনী প্রচার চালাবেন। সেই সঙ্গে জনতাকে তিনি শান্ত ও সংযত থাকার আবেদন জানিয়েছেন।
ভিডিও বার্তায় মমতা বলেন, দুয়েকদিনের মধ্যেই তিনি প্রচার শুরু করবেন।
তবে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী শনিবার থেকে মমতা প্রচার শুরু করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী প্রচার কর্মসূচি ঠিক করা হবে বলে জানান তাঁরা।
ভিডিও বার্তায় মমতা কোনো হামলার অভিযোগ করেননি। তিনি বলেন, গাড়িতে দাঁড়িয়ে আমি যখন সকলকে নমস্কার করছিলাম তখন এমন জোরে চাপ আসে যে গাড়ির দরজা আমার পায়ের উপর চেপে যায়।
নন্দীগ্রামে মমতার পায়ে চোট পাওয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এজেন্ট শেখ সুফিয়ানের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
“বুধবার মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির দরজা কে বা কারা ধাক্কা দিয়েছে সেটা নিয়েই রহস্য তৈরি হয়েছে,” মন্তব্য করে তৃণমূল কংগ্রেসের নন্দীগ্রামের স্থানীয় নেতা বাপ্পাদিত্য গর্গ বেনারকে বলেন। সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
নির্বাচনের প্রধান আকর্ষণ নন্দীগ্রাম
এর আগে মমতার নির্বাচনী এলাকা ছিল দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর, তবে এবার তিনি মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম থেকে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামপন্থী সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির জন্য ২০০৭ সালের শুরুতে নন্দীগ্রামে এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করতে চাইলে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় ওই বছরের মার্চে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অন্তত ১৪ জন।
কয়েক দশকের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে মমতার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আরোহনের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত নন্দীগ্রামের এই জমি আন্দোলন। তখন ওই অঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান নেতা ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী।
গতবার তৃণমূলের হয়ে এই আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন শুভেন্দু, যিনি সম্প্রতি তৃণমূল ছেড়ে ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) যোগ দিয়ে এবার সেখানে নির্বাচন করবেন মমতার বিরুদ্ধে।
“নন্দীগ্রামে এবারের নির্বাচনে আকর্ষণীয় লড়াইয় হবে। মমতা এবং শুভেন্দু দুজনেই তাঁদের রাজনৈতিক কেরিয়ারকে বাজি ধরে এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। মমতা নন্দীগ্রামে নির্বাচনে দাঁড়ালেও শুভেন্দুর শিকড় রয়েছে নন্দীগ্রামের মাটিতেই,” বেনারকে বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ।
বামপন্থীদের হারিয়ে ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০১৬ সালেও তারা জয়ী হয়। রাজ্যের ২৯৪টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পায় ১৮৪টি আসন। বাকি আসনের মধ্যে বামপন্থীরা পায় ৬০টি ও কংগ্রেস ৪২টি আসন।
এবার মোট আট দফায় আগামী ২৭ মার্চ শুরু হয়ে ২৯ এপ্রিল শেষ হবে পশ্চিমবঙ্গের ১৭তম বিধানসভার নির্বাচন। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবে ২ মে।
এবারের নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক মন্ত্রী, বিধায়ক এবং অনেক স্থানীয় নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। গত লোকসভা (২০১৯) নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পেয়েছিল ৪০ শতাংশ ও তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৪৩ শতাংশ ভোট।
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি এবার নির্বাচন হচ্ছে আসাম, তামিলনাডু, কেরালা রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরিতে।