যেকোনো আইন ও তার বাস্তবায়ন বিধি একটা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন উদ্যোগে বাংলাদেশ ভাবছে কেন?
যেকোনো বিধি-বিধান তৈরি অবশ্যই একটা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে ভারতের ২০১৯ সালের সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা ‘সিএএ-১৯’ নামে পরিচিত আইনে বাংলাদেশের উল্লেখ ছিল। ফলে সম্প্রতি যখন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেই আইন কার্যকরের ঘোষণা দেওয়া হলো, তখন সংগত কারণে বাংলাদেশে সেটা নিয়ে আলোচনা উঠেছে। ‘সিএএ-১৯’ এ বাংলাদেশ ছাড়াও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের উল্লেখ রয়েছে। সেই কারণে এটা কেবল ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে থাকছে না। আবার এই আইনের ব্যাখ্যায় শ্রীলঙ্কা ও তিব্বতের প্রসঙ্গও আসছে। ফলে এটা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার একটা আইনগত-রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে। তবে বাংলাদেশের জন্য এটা বিশেষভাবে তাৎপর্যবহ।
এই আইন নিয়ে বাংলাদেশের ভাবনার জায়গা কোথায়?
এই আইন নিয়ে বাংলাদেশের ভাবার আছে অনেক কিছু। আবার এই আইনের কারণে এমন একটা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে, যাতে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের ব্যাপারও আছে। যেমন: এই আইন ও তার ‘রুলস’ বলছে, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা (মুসলিম ছাড়া অন্যান্য ধর্মের) বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হয়ে ভারতে যেয়ে বসবাস করছেন, তারা সেখানে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এর পরোক্ষ অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন চলছে এবং সেই নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে মানুষ ভারত যাচ্ছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এক্ষেত্রে বারবার যে শব্দ দুটি ব্যবহার করছেন তাহলো ‘নিপীড়িত সংখ্যালঘু’।
এই আইনে যদি হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা থাকে, তাহলে হিন্দু-প্রধান ভারতে তো ব্যাপারটা অভিনন্দিত হওয়ার কথা। সেখানেও এর বিরোধিতা কেন?
ভারত নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে দাবি করে। এই দাবির সাংবিধানিক ভিত্তি আছে। কিন্তু সিএএ-১৯ আইনের আওতায় তারা নাগরিকত্ব দিতে চাইছে কেবল অমুসলিমদের। কোনোভাবেই মুসলিমদের নয়। অর্থাৎ ভারত তার নাগরিকত্ব আইনের ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে বেছে নিয়েছে। অন্যভাবে বললে ভারতে মানুষের বৈধতা বা অবৈধতার মানদণ্ড দাঁড়াচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়। এই কারণে সেখানে যারা দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দেখতে চাইতেন, তারা নতুন আইনগত সংশোধনীর বিরোধিতা করছেন। বেছে বেছে তিনটি মুসলমান-প্রধান দেশের অমুসলিমদের নিয়ে এভাবে কোনো আইনি উদ্যোগ নেওয়া ঘটনা হিসেবে অভিনব। দেখা যাচ্ছে, ভারতের অন্যতম প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে লাখো রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয়ের জন্য ঘুরলেও তারাও নতুন আইনের সুযোগ পাবে না। এ অধ্যায়ের আরেকটি তাৎপর্য হলো নির্বাচনের আগে আগে এই আইন কার্যকরের ঘোষণা হলো, যা পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনকালে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাতে পারে। বিজেপি-বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতার এটাও এক কারণ।
নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা থেকে মুসলমানদের বাদ দেওয়ার পক্ষে ভারত সরকারের যুক্তি কি?
ভারত সরকার বলছে তারা ‘সিএএ-১৯’ কার্যকরে মানবাধিকারকে বিবেচনায় নিয়েছে। তাদের ভাষায়, বাংলাদেশ-আফগানিস্তান-পাকিস্তানে যেহেতু হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুরা মানবাধিকার বঞ্চনার শিকার, সেই কারণে তারা মুসলিমদের বাদ দিয়ে অমুসলিমদের কেবল আইনি সুবিধা দিতে চাইছে। তবে এই দাবির কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো শ্রীলঙ্কা থেকে যেসব হিন্দু তামিল সিংহলি সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা নিপীড়িত হয়ে তামিল নাড়ুতে এসেছে, তাদের নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বাংলাদেশে কি সংখ্যালঘু নিপীড়ন হয়?
ভারতের সিএএ-১৯ এর ইঙ্গিত তো বুঝতে পারছে সকলে। যেহেতু বিষয়টা অপর দেশের উচ্চস্তর থেকে এলো, সেই কারণে এর সত্য-মিথ্যা জানানোর দায় বাংলাদেশ প্রশাসনের। যদি ভারতে এই আইনের সুযোগে সেখানে নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় বাংলাদেশের কেউ ধর্মীয় নিপীড়নের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন, তাহলে এখানকার প্রশাসনের তো বিষয়টা তদন্ত করে দেখার সুযোগ আছে। নিশ্চয়ই সেটা করা হবে। কারণ তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত। দেশের মতোই বিদেশেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হলে সেটা তদন্ত করে দেখা দরকার।
সিএএ আইনে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরকে কেন নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য নির্ধারক তারিখ করা হলো, সেই প্রশ্নও উঠেছে। তর্কের খাতিরে বলা যাক যে, এর মানে কি ওই তারিখের আগে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানে অমুসলিমদের ওপর ধর্মীয় নিপীড়ন হলেও তার পর আর হবে না? ২০১৪ সালের আগে বাংলাদেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বহুদল বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। তারা কি এরকম একটা অভিযোগ মেনে নিবে যে, তাদের আমলে এখানে সংখ্যালঘুদের ওপর ধর্মীয় নিপীড়ন ঘটেছে? এরকম জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়ার দায় ওইসব দলেরই।
ভারতের এই আইনি উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তির কারণ কি কেবল এটুকুই যে দেশকে সংখ্যালঘু নিপীড়ক দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে তুলে ধরা হচ্ছে?
না, আরও কারণ আছে। সেটা এই আইনের পরিসর ছাড়িয়ে অন্যত্র। অনুমান করা হচ্ছে সিএএ-১৯ বাস্তবায়নের পর পশ্চিমবঙ্গসহ পুরো ভারতে জাতীয় নাগরিকপুঞ্জির (এনআরসি) ঘোষণা আসবে। সেখানে নীতি-নির্ধারকদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে এটা অনুমিত হয়, তারা নাগরিকত্ব ও অনুপ্রবেশ বিষয়ে এরকম ধারাবাহিক পদক্ষেপের কথাই বলেছেন এতদিন। অর্থাৎ আগে ‘সিএএ’র মাধ্যমে অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়া শেষ হবে। তারপর এনআরসি হবে। ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন পুরো দেশে এনআরসি বাস্তবায়ন হবে। বলাবাহুল্য, যদি ‘সিএএ-১৯’ এর মাধ্যমে অমুসলিম অধিকাংশজন নাগরিকত্ব পেয়ে যান, তাহলে সম্ভাব্য এনআরসিতে আটকা পড়বেন মূলত নাগরিকত্বের কাগজপত্রহীন মুসলমানরা। উদ্বেগের বিষয়, সম্ভাব্য এই ‘কাগজপত্রহীন মুসলমান’দের নিয়ে ভারত কী করবে?
ভারত ‘অবৈধ’ মানুষদের নিয়ে কী করবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে ভাবতে হচ্ছে কেন?
মুশকিলটা ঠিক এখানেই। যেকোনো কারণে কোনো দেশে কোনো একজন মানুষের কাছে নাগরিকত্বের বৈধ কাগজপত্র না থাকতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ইত্যাদি জায়গার অভিজ্ঞতা হলো এরকম মুসলমান মাত্রই ধরে নেওয়া হয় তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে সম্ভাব্য এনআরসিতে আটকে যাওয়া মুসলমানদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে তুলে ধরা হতে পারে। আসামে যখন এনআরসি হলো, তখন প্রায় ১৯ লাখ ছয় হাজার ৬০০ মানুষ নাগরিকত্বের কাগজপত্র দেখাতে পারলেন না এবং বলা হতে থাকলো তারা ‘বাংলাদেশি’। অথচ ওই কথিত বাংলাদেশিরা বলছে তারা আসামেরই মানুষ। নানান কারণে তাদের কাছে নাগরিকত্বের কাগজপত্রগুলো নেই। এদের মধ্যে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের বাইরে গুর্খা, রাজবংশীও ছিলেন। হিন্দুই ছিলেন বেশি। তখন অনেক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বলছিল আগে ‘অবৈধ’ হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক—পরে এনআরসি হোক। সেই অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো ভারত সরকার এখন ‘সিএএ’র মাধ্যমে হিন্দুদের এনআরসিকালীন ঝামেলা থেকে আগে মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যেহেতু মুসলমানরা ‘সিএএ’র সুবিধা পাবে না—সুতরাং আসামের মতো করে পুরো দেশে এনআরসি শুরু হলে মূলত ঝামেলায় পড়বে নাগরিকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রহীন মুসলমানরা। তাদের ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে প্রচারের শঙ্কা আছে।
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তাতে এরকম অবস্থা ঘটবে না বলে অনেকের অনুমান। তাহলে ভারত কেন এরকম দাবি তুলছে এবং বাংলাদেশকে এখন বিব্রত করছে?
এটা সত্য যে বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সরকারের মাঝে বন্ধুত্ব বিরাজ করছে। তার ভিত্তিতে চাইলে এটা অনুমান করা যায়, ভারত সরকার তার দেশে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ থাকার বিষয় উল্লেখ করবে না। তবে বহুবার ভারতের জাতীয় ও আঞ্চলিক নেতারা আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সমাবেশে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। আর সবচেয়ে বড় বিষয় বহুল আলোচিত ‘বন্ধুত্বে’র সময়েই ‘সিএএ-১৯’ আইনে বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু নিপীড়ক হিসেবে চিহ্নিত হতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কারো কারো সন্দেহ হতে পারে, ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্বকে প্রকৃত মূল্যই দিচ্ছে কি না?
প্রসঙ্গক্রমে এও উল্লেখ করতে হয়, কথিত অবৈধ মুসলমানদের নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে প্রচার ও প্রশাসনিক কৌশলের পরিবর্তন ঘটছে। সেখানে কথিত ‘অবৈধ মুসলমান’দের আগের মতো ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ না বলে ‘অবৈধ রোহিঙ্গা’ বলা হচ্ছে।
ভারত যদি সেখানকার কোনো অ-নাগরিক মুসলিমকে ‘অবৈধ রোহিঙ্গা’ বলে, তাহলে বাংলাদেশের সমস্যা কোথায়?
ভারত আন্তর্জাতিক রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী নয়। তার দেশে কাউকে যখন ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তখন ওই মানুষদের শরণার্থী মর্যাদা দিতে হয় না। সেখানকার প্রশাসন তখন ওইরকম ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ফরেনার্স অ্যাক্টে অনুসরণ করে। ভারত এও বলছে, কথিত রোহিঙ্গারা হলো তার জন্য ‘নিরাপত্তা হুমকি’। ফলে নিশ্চিতভাবে এই ‘নিরাপত্তা হুমকি’দের প্রতি তার রাষ্ট্রীয় আচরণ হবে অতি কঠোর। প্রশ্ন হলো, ‘নিরাপত্তার হুমকি-বিদেশি-অবৈধ-রোহিঙ্গা মুসলমান’দের তারা কি কারাগারে রাখবে? নাকি কোনো দিকে ঠেলে দিতে চাইবে? যেহেতু রোহিঙ্গাদের প্রধান আশ্রয় শিবিরগুলো বাংলাদেশে—সুতরাং এ বিষয়ে তখন বাংলাদেশের প্রসঙ্গও আসবে কি না? কিংবা প্রশাসনিক, আইনগত ও সামাজিক চাপে পড়ে ভারতের ওই ‘অবৈধ রোহিঙ্গা’রা কোনো দিকে চলে যেতে চাইবে কি না?
ভারতের ফরেনার্স অ্যাক্টের সেকশন তিন ও পাঁচ সরকারকে এরকম মানুষদের আটকে রাখার ক্ষমতাও দিয়ে রেখেছে। সবমিলে এনআরসির পর নাগরিকত্বের কাগজ নেই এমন ব্যক্তিদের ঘিরে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা আছে।
ভারতে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘সিএএ-১৯’র পর যদি এনআরসি হয়, তাহলে অনেক হিন্দুও নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারেন। বহু ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণে অনেক হিন্দু নাগরিকত্বের কাগজপত্র দেখাতে পারবেন না। সম্ভাব্য এই কারণে এই লেখা তৈরির সময় কলকাতার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ডে একজন হিন্দুর আত্মহত্যার ঘটনা তোলপাড় তুলেছে। ‘অবৈধ’ হয়ে পড়ার ভীতি সেখানে হিন্দুদের মধ্যেও ছড়িয়েছে। তারা কোথায় যাবেন? কোথায় শরণার্থী হবেন?
ভারত তার অবৈধ নাগরিকদের নিয়ে কী করবে, কাকে ‘শরণার্থী’ মর্যাদা দেবে, সেটা কি তাদের নিজস্ব বিষয় নয়?
কৌতূহলোদ্দীপক দিক হলো ভারত তার দেশে থাকা তিব্বতিদের ও শ্রীলঙ্কার তামিলদের শরণার্থী মর্যাদা দেয়। কিন্তু মুসলমানদের ‘রোহিঙ্গা’ উল্লেখ করে সেটা দিতে চাইছে না বা দিবে না বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। হয়তো মানুষদের তারা ধর্ম ও রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখে বলে এমন ঘটে। আবার বহির্বিশ্বেও ধর্মীয় বিবেচনাতেই বিষয়টি দেখা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেও ‘সিএএ-১৯’র পর মুসলমানদের পরিণতি নিয়ে বেশি ভাবা হচ্ছে।
আলতাফ পারভেজ: স্বাধীন গবেষক