Skip to content

ব্রিকসে যোগদানের প্রশ্নে ঢাকা কি দিল্লির পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছে? – BBC News বাংলা

ব্রিকসে যোগদানের প্রশ্নে ঢাকা কি দিল্লির পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছে?  - BBC News বাংলা

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

আন্তর্জাতিক জোট ব্রিকসে যোগদান করতে চেয়ে বাংলাদেশ যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, সে ব্যাপারে তাদের প্রতিবেশী ও মিত্র দেশ ভারতের অবস্থান কী, তা নিয়ে বেশ কিছুটা ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

ব্রিকসের সম্প্রসারণের প্রশ্নে জোটের অন্যতম সদস্য ভারতের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য হল, জোটে নিশ্চয় নতুন নতুন দেশকে স্বাগত জানানো দরকার – কিন্তু জোটের ভেতরে ‘আঞ্চলিক ভারসাম্য’ যাতে রক্ষিত হয় সেটাও দেখাটা খুব জরুরি ।

পর্যবেক্ষকরা এটারই ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ অর্থ করছেন এভাবে – ব্রিকসে যাতে চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা বেশি বেশি দেশ ঢুকে গিয়ে জোটের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যটা নষ্ট না-হয়ে যায়, ভারত সে দিকেও সতর্ক নজর রাখতে চাইছে।

দিল্লিতে একাধিক সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এই পটভূমিতে চীন না ভারত – কাদের ‘ক্যান্ডিডেট’ হিসেবে বাংলাদেশ ব্রিকসে ঢুকতে চাইবে তার ওপরই সম্ভবত নির্ভর করবে এই প্রচেষ্টার পরিণতি।

বাংলাদেশ অবশ্যই চাইবে চীন ও ভারত উভয়েরই সমর্থন নিয়ে ব্রিকসের অংশ হতে, কিন্তু এই মুহুর্তে বেজিং ও দিল্লির মধ্যেকার সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে তাতে সেটা কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্নচিহ্ন থাকবে।

সম্পর্কিত খবর :

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

কেপটাউনে ব্রিকস জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা, জুন ২০২৩

এই পটভূমিতেই চলতি মাসের ২২ থেকে ২৪ তারিখ দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে – আর সেখানে বাংলাদেশ-সহ আরও অন্তত বিশ-পঁচিশটি দেশের যোগদান নিয়ে চুলচেরা আলোচনা হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে হয়তো সশরীরে জোহানেসবার্গে যাচ্ছেন না, তিনি শেষ পর্যন্ত ভাচু‍র্য়ালি ওই সামিটে অংশ নেবেন বলেই দিল্লিতে সরকারি সূত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

সে ক্ষেত্রে তিনি নিজে কতটা বাংলাদেশের আবেদন নিয়ে সওয়াল করতে পারবেন, সেটাও একটা দেখার বিষয় হবে।

আড়াই বছর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক ভাচু‍র্য়াল সামিটে প্রধানমন্ত্রী মোদীই তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ‘ব্রিকস ব্যাঙ্কে’ যোগ দিক এবং তাদের নানা প্রকল্পের সুযোগ গ্রহণ করুক।

তবে বাংলাদেশ সরাসরি ব্রিকসেও আসুক, এটা কিন্তু কখনো ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়নি।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

সাংহাই-তে ব্রিকসের প্রতিষ্ঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক

ফলে আজ যখন বাংলাদেশ নিজে থেকেই ব্রিকসে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করছে – তখন সেই প্রশ্নে দিল্লি কিন্তু তাদের আস্তিনের তাস এখনও বের করেনি।

সপ্তাহ তিনেক বাদে জোহানেসবার্গে ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চেই তাই বোধহয় স্পষ্ট হবে বাংলাদেশের আবেদন নিয়ে ভারত ঠিক কী ভূমিকা নেয়।

যা নিয়ে সংশয়

ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনকে নিয়ে ‘ব্রিক’ অর্থনৈতিক জোট আত্মপ্রকাশ করেছিল ২০০৯ সালে। পরের বছর ওই জোটে যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা – ফলে ‘ব্রিক’ থেকে জোটের নতুন নামকরণ হয় ‘ব্রিকস’।

বিগত এক যুগেরও বেশি সময়ে ব্রিকসে কিন্তু নতুন করে আর কোনও দেশ যোগ দেয়নি।

তবে এই সময়ের মধ্যেই ব্রিকস নিজেদেরকে আমেরিকা তথা পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিকল্প একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছে।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

উভয়েই ব্রিকসের শরিক হলেও ভারত ও চীনের মধ্যে দূরত্ব রয়েই গেছে

বিশেষ করে ‘গ্লোবাল সাউথে’র কন্ঠস্বর হিসেবে ব্রিকস একটা আলাদা পরিচয়ও অর্জন করেছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে ধনী সাতটি দেশের জোট জি-সেভেনের শেয়ার যখন গত বছর ৩০ শতাংশে নেমে গেছে, ব্রিকসের পাঁচটি দেশের ভাগ কিন্তু ৩১.৭ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

এমন কী ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপি-তে ব্রিকসের শেয়ার ৫০ শতাংশে পৌঁছে যাবে বলেও বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস করছেন।

ফলে এশিয়া, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত বিশ-পঁচিশটি দেশ কেন এখন ব্রিকসের অংশ হতে চাইছে, সেটা বোঝা তাই কঠিন নয়।

এদের মধ্যে অনেকে আনুষ্ঠানিক আবেদনও ইতিমধ্যেই জমা দিয়েছে, যার অন্যতম হল বাংলাদেশ। বাকি আরও কিছু দেশ মৌখিকভাবে আবেদন করে রেখেছে।

ব্রিকসে যোগদান করতে যারা ইচ্ছুক তার মধ্যে আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, মিশরের মতো বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী অর্থনীতি আছে। এমন কী সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নামও এই তালিকায় আছে বলে শোনা যাচ্ছে।

এখন দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকসের ‘চেয়ার’ হলেও এর আগে যখন চীন ওই পদে ছিল, তখন থেকেই কিন্তু জোরেশোরে জোটের এই সম্প্রসারণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ভারত ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। ২০২২

“আর ঠিক তখন থেকেই ভারত এই পদক্ষেপকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখে আসছে খুব সঙ্গত কারণেই”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী।

ঢাকায় ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও মনে করেন, চীন বা রাশিয়া উভয়েই চেয়েছে তাদের ঘনিষ্ঠ দেশগুলো ব্রিকসে আসুক – কারণ তাতে জোটের ভেতরে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের পাল্লা শক্ত হবে।

অন্যদিকে ব্রিকস যাতে আরও বেশি করে চীনের দিকে ঝুঁকে না-পড়ে – ভারত সেটাই নিশ্চিত করতে চেয়েছে এবং সেই জন্য চীনের ‘অনুমোদন’ নিয়ে যে সব দেশ ব্রিকসের সদস্য হতে চেয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা সাবধানী মনোভাব নিয়েছে বলেই মি চক্রবর্তীর মূল্যায়ন।

বাংলাদেশ যদিও ঠিক সেই ক্যাটেগরিতে পড়ে না – তারপরেও বাংলাদেশের আবেদনকে ভারত যে এখনও প্রকাশ্যে ও স্পষ্টভাবে ‘এনডোর্স’ করেনি, তার অন্যতম কারণ এটাই।

‘দিল্লির এগিয়ে আসা উচিত’

দিল্লিতে স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক অবশ্য মনে করছেন ভারতের উচিত হবে ব্রিকসে বাংলাদেশের সমর্থনে প্রকাশ্যে ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এগিয়ে আসা।

“ভারত যদি এ ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট না-করে তাহলে চীন সেই জায়গাটা নিয়ে নেবে এবং দেখাতে চাইবে তারাই ব্রিকসের ভেতরে বাংলাদেশের হয়ে লড়ছে।”

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

ব্রিকসের বর্তমান চেয়ার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা

“তার চেয়ে ভারতের জন্য অনেক ভাল হবে যদি তারা নিজে থেকেই বাংলাদেশের আবেদনটা ফেসিলিটেট করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ড: পট্টনায়ক।

বাংলাদেশে চীনের প্রভাবকে খর্ব করার চেষ্টায় অতীতে ভারতকে বহু পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে, তাই এক্ষেত্রেও সেটা না-করার কোনও কারণ নেই বলেই তাঁর অভিমত।

দিল্লির বর্ষীয়ান কূটনৈতিক সংবাদদাতা ও বাংলাদেশ ওয়াচার গৌতম লাহিড়ী আবার মনে করছেন ভারতের এই দ্বিধার পেছনে দিল্লি-ওয়াশিংটনের সম্পর্কও একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে।

“মনে রাখতে হবে ভারত যেমন ব্রিকসের সদস্য, তেমনি আবার কোয়াডেরও সদস্য!”

ভারত শুধু ব্রিকসকে নিয়েই পড়ে আছে এবং ব্রিকসে নতুন নতুন সদস্যকে ঢোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, এটা ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুব ভাল ‘অপটিক্স’ নয় বলেই আমার ধারণা”, বিবিসিকে বলছিলেন গৌতম লাহিড়ী।

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান,

দক্ষিণ আফ্রিকা একথা নিশ্চিত করেছে যে নতুন বহু দেশ জোটে যোগ দিতে ইচ্ছুক

তিনি মনে করছেন, বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদান নিয়ে ভারত যে খুব বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে না তার একটা বড় কারণ এটাই।

ব্রিকসের সম্প্রসারণ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও অবধি প্রকাশ্যে একটাই মন্তব্য করেছে – আর সেটা হল “নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে জোটের পাঁচ শরিক মিলেই সিদ্ধান্ত নেবে।”

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যথারীতি ব্রিকসের বর্তমান সদস্য দেশগুলো মিলেই সিদ্ধান্ত নেবে – কিন্তু সেখানে আলাদাভাবে ভারত বা চীন তাদের জন্য কোনও সক্রিয়তা দেখায় কি না সেটাই এখন দেখার।

তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বিবিসি বাংলাকে এটাও জানিয়েছেন, সম্প্রসারণ নিয়ে শরিকরা একমত হলেও বাংলাদেশ-সহ অন্য দেশগুলো সেপ্টেম্বরের সামিটেই জোটের পূর্ণ সদস্যপদ পেয়ে যাবে, “এটা ভাবাটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি!”

“খুব সম্ভবত এই নতুন দেশগুলো প্রথমে অবজার্ভার (পর্যবেক্ষক) বা সহযোগী সদস্যর মর্যাদা পাবে, তারপর দু’বছর বা তিন বছর বাদে তাদের পূর্ণ সদস্য করা হবে”, জানাচ্ছেন তিনি।

ফলে বাংলাদেশের আবেদন গৃহীত হলেও তাদেরও কিন্তু সেই একই ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, যদিও সেই প্রক্রিয়াটা ঠিক কী হবে তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

বার্তা সূত্র