Friday, January 17, 2025

সপ্তাহে শীর্ষে

প্রাসঙ্গিক বার্তা

ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের মহা-বাঁধ প্রকল্প অনুমোদন

বাংলাদেশ, ভারত ও তিব্বত অঞ্চলে প্রাণ ও পরিবেশের জন্য অশনি সংকেত

আরএফএ, তিব্বত: বাংলাদেশ, ভারত ও তিব্বতি মানুষের বহুমাত্রিক উদ্বেগের তোয়াক্কা না করে ব্রহ্মপুত্র নদীর উজানে মহা-বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে চীন সরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের বৃহত্তম এই জলবিদ্যুৎ ড্যাম নির্মিত হলে বাংলাদেশ, ভারত ও তিব্বতের ভূপ্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে জীববৈচিত্র্য, বাস্তুচ্যুত হবে হাজার হাজার মানুষ এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে অনেক ধর্মীয় স্থাপনা, তীর্থস্থান ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।

চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদীর নিম্ন প্রবাহে মেদোগ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে চীনা সরকার।

এই বাঁধ প্রতি বছর ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা চীনের বিশাল থ্রি গর্জেস ড্যামের তুলনায় তিনগুণ বেশি।

ইয়ারলুং সাংপো নদী পশ্চিম তিব্বতের হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতে ব্রহ্মপুত্র এবং বাংলাদেশে যমুনা নদী নামে প্রবাহিত হয়। প্রকল্প অঞ্চলটি তিব্বতিদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র এবং জীববৈচিত্র্যময় অঞ্চলগুলোর একটি।

নির্মাণকাজ কখন শুরু হবে এবং শেষ হবে, অথবা নতুন বাঁধ প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করেনি চীন। এতে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কত হবে, এলাকাগুলোর ওপর কী প্রভাব পড়বে এবং পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক পরিণতি কেমন হতে পারে কিছুই জানায়নি।

তবে বিশেষজ্ঞ এবং অধিকার কর্মীরা বলছেন, নিংচি শহরের ইয়ারলুং জাংবোর বিশালাকায় গিরিখাতে এর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হবে এবং চীন এই বাঁধটি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।

এটি প্রায় নিশ্চিতভাবেই জলপ্রবাহের ধরন এবং স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপর প্রভাব ফেলবে। জল সুরক্ষা নিয়েও উদ্বেগ বাড়বে, কারণ চীন এই বাঁধ ব্যবহার করে ভাটিমুখে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ভারতের জল সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ শ্রীকান্তাইয়া বেনারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেছেন, “নদীর ওপর যে কোনো বাঁধ ভাটিতে বিশাল পরিবেশগত প্রভাব ফেলে।”

তাছাড়া, “ড্যামের কার্যক্রমের তথ্য অপ্রকাশিত রেখে চীন একে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে,” বলেন তিনি।

“লাওসে মেকং নদীর উপর চীন যে বাঁধগুলো তৈরি করেছে সেগুলো বিশেষত খরার বছরগুলোতে ভাটির দেশগুলোর ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে এবং চীন কীভাবে নিজেদের স্বার্থে সেগুলো পরিচালনা করছে তা থেকে ভারত শিক্ষা নিতে পারে,” বলেন শ্রীকান্তাইয়া।

গবেষণায় দেখা গেছে, মেকং নদীর উজানে চীনের ১১টি বৃহৎ বাঁধ গত দুই দশকে ভাটি অঞ্চলে প্রায়শ তীব্র খরা পরিস্থিতি তৈরি করছে। এই বাঁধগুলো থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার মতো ভাটির দেশগুলোতে পানি প্রবাহ সীমিত বা অবরুদ্ধ করেছে। পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য ব্যাহত করেছে এবং নদী ভাঙন ঘটিয়েছে।

তিব্বতিদের প্রতিবাদ

চীনের বাঁধ প্রকল্পগুলো অতীতে বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এই বছরের শুরুর দিকে তিব্বতের ড্রিচু নদীর (চীনে জিনশা নামে পরিচিত) উজানে কামতোক বা গাংতুয়ো বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সহস্রাধিক তিব্বতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই প্রকল্পটি দেগে প্রদেশের অন্তত দুটি গ্রাম এবং ছয়টি বৌদ্ধ মঠকে প্রভাবিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বেইজিংয়ের ইয়ারলুং জাংবো গিরিখাতে এই বাঁধ নির্মাণের জন্য বেইজিংয়ের বিনিয়োগ ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে মনে করা হচ্ছে, যা থ্রি গর্জেস ড্যাম প্রকল্পের মোট বিনিয়োগ ৩৪.৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে চারগুণ বেশি।

এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তবর্তী তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নিংট্রি (নিয়ংচি) প্রাদেশিক এলাকার মেদোগ (চীনা ভাষায় মোতুও) বিভাগে নির্মিত হবে।

উত্তর ভারতের জলবায়ু কর্মী ও গবেষক মানশি আশের রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, “হিমালয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর নেতিবাচক প্রভাবের যথেষ্ট প্রমাণ ইতোমধ্যেই রয়েছে।”

“এই প্রকল্পটি নিঃসন্দেহে নদীর পরিবেশগত প্রবাহকে পরিবর্তন করবে। বাঁধ যত বড় হবে, নদীর প্রবাহের উপর প্রভাব তত বেশি হবে,” বলেন তিনি।

এই বাঁধ এবং জলাধার তৈরির জন্য কত মানুষকে সরে যেতে হবে তা স্পষ্ট নয়।

থ্রি গর্জেস বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় ১৪ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছিল। তবে ইয়ারলুং সাংপো নদীর আশেপাশের যে এলাকাটিতে মেদোগ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা ইয়াংজি নদীর এলাকার তুলনায় কম জনবসতিপূর্ণ। থ্রি গর্জেস বাঁধটি ইয়াংজি নদীর ওপর নির্মিত হয়েছিল।

ভারত ও বাংলাদেশের ওপর প্রভাব

এই বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রবাহ পরিবর্তন করতে পারে। এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশ ও আসামের কৃষি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানীয় জলের প্রাপ্যতা বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লে পলিসি ইনিশিয়েটিভের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা নীরাজ সিং মানহাস।

“জল নির্গমনের মৌসুমি পরিবর্তন ভাটির দিকে বন্যা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং খরা তীব্রতর করতে পারে, যা জীবিকা এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করবে,” মানহাস বলেন।

তার মতে, আরও ভাটিতে বাংলাদেশে নদীর প্রবাহের সম্ভাব্য হেরফের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপের জন্য হুমকিস্বরূপ, যা দেশের কৃষি ও মৎস্য শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

“বাঁধের কারণে পলিমাটি আটকে যাওয়ায় মাটির উর্বরতা কমতে পারে এবং বদ্বীপে ক্ষয় ত্বরান্বিত করতে পারে,” বলেন মানহাস।

“কৌশলগতভাবে এই বাঁধটি নদীর তীরবর্তী প্রতিবেশীদের ওপর চীনের প্রভাব প্রভাব বাড়িয়ে তুলবে, যা ইতোমধ্যে সংবেদনশীল ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াতে পারে।”

মানহাস বলেন, এই উদ্বেগগুলোর সমাধানে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়কেই চীনের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন হতে পারে।

ভূমিকম্পের উদ্বেগ

আরেকটি প্রধান উদ্বেগ হল মেদোগ জলবিদ্যুৎ বাঁধের অবস্থান ভূতাত্ত্বিকভাবে অস্থিতিশীল অঞ্চলে, যা ভূমিকম্প এবং ভূমিধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাঁধটি যে বিশাল পরিমাণ পানি ধারণ করবে, তা এসব বিপদ আরও তীব্র করতে পারে, বলেছেন শ্রীকান্তাইয়া।

ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর তিব্বতের একটি সমীক্ষা অনুসারে চীন ২০০০ সাল থেকে তিব্বতে অন্তত ১৯৩টি জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করেছে বা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৮০% বিশাল আকারের।

১৯৩টি বাঁধের মধ্যে ৬০% এরও বেশি এখনও প্রস্তাব বা প্রস্তুতির পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। এই বাঁধগুলো সম্পূর্ণ হলে ১২ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে এবং ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করতে পারে, মানবাধিকার সংগঠনটি জানিয়েছে।

ভারতের ধর্মশালায় অবস্থিত তিব্বত পলিসি ইনস্টিটিউটের জলবায়ু গবেষক ডেচেন পালমো বলেছেন, ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর বাঁধটির সুনির্দিষ্ট বিবরণ এখনও প্রকাশ করা না হলেও প্রকল্পটি সম্ভবত তিব্বতিদের স্থানচ্যুতি এবং প্রাচীন মঠগুলোর ধ্বংস সাধন করবে।

তিনি বলেন, নতুন মহা-বাঁধটি পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি করবে যা ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে, যেমনটি তিব্বতের নদীগুলিতে চীন নির্মিত একাধিক বাঁধের ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

সূত্র: বেনার নিউজ

পাঠক প্রিয়