Skip to content

ব্যর্থতা ঢাকতে নানা ধরনের নাটক করছে সরকার: ফখরুল

ব্যর্থতা ঢাকতে নানা ধরনের নাটক করছে সরকার: ফখরুল

সারা দেশে একশর বেশি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার আভাস দিয়েছেন। বারবার মনোনয়ন চেয়েও বঞ্চিত হওয়া এ অংশটি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘নো রিটার্ন পজিশন’নীতি অনুসরণ করবে বলে জানিয়েছে। এ অবস্থানে থাকা সবাই সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনীতি করা। জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা অনেকেও আছেন এই দলে, যাদের বয়স ৫০-৬০-এর কোটায়।

দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া, দলীয় কার্যালয়ের সামনে ঘোরাফেরা করা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে গিয়ে দল মনোনয়ন না দিলে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবেন বলে জানাচ্ছেন তারা। দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হলে এ প্রতিবেদককে মনোনয়নের প্রত্যাশায় থাকা নেতারা বলেন, এমনও হতে পারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে কোনো বিধিনিষেধ আসবে না। অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের বিবেচনায় ‘ঘাপলা’ হয় বলেই যোগ্যতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হলেও মনোনয়নবঞ্চিত হতে হয় ভালো ভাবমূর্তির প্রার্থীদেরও। এগুলো দলের জন্য খারাপ নজির। মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন এমন নেতারা আরও বলেন, একেকজন নেতা শুধু পেয়েই যাচ্ছেন, অন্য নেতারা সবসময়ই বঞ্চিত হচ্ছেন এতে রাজনীতি নষ্ট হয়। অনেকের দম্ভ বেড়ে যায়, নেতাকর্মীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। তারা নিজেদের বিকল্পহীন ভাবতে শুরু করে।

তারা বলেন, বঞ্চিত হতে হতে এমন বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে চলে যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে খোকন সেরনিয়াবাতকে যখন মনোনয়ন দিই বোর্ডের একজন সদস্যও আমাকে সমর্থন করেনি। পরে দেখলাম আমিই ঠিক। সঠিক প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ বক্তব্য টেনে তারা বলেন, নেত্রী চাইলেও (শেখ হাসিনা) ঘাপলা করে অন্যরা। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের বহিষ্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের মেয়র পদে বিজয়ী হওয়ার ঘটনা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সাহস জোগাতে শুরু করেছে। জাহাঙ্গীর যে কায়দায় রাজনীতি করেছেন, সারা দেশে অন্তত দেড়শ উপজেলায় সে কায়দায় রাজনীতি করছেন অন্তত দুইশ থেকে আড়াইশ আওয়ামী লীগ নেতা।

তবে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সারা দেশে কোটি কোটি নেতাকর্মী আছেন। বলা যায় বেশিরভাগই যোগ্য। কিন্তু মনোনয়ন দিতে হয় তিনশজনকে। ফলে বঞ্চিত হওয়া অনেকেই কষ্ট পান। এটা ঠিক যে, এ ক্ষেত্রে যোগ্যকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে কম যোগ্যকে বেছে নিতে হয়। সেদিক থেকেও অনেকেই কষ্ট পান। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ যাবে না সে বিশ্বাস আছে।’

বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জানান, ২০১২ সালের পর আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে বা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে দলের পদ পাওয়া ও টাকার কুমির বনে যাওয়া নেতারাই সংখ্যায় এখন বেশি। মনোনয়ন না পেলে তারা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করার সাহস দেখাবেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তত ছয়জন নেতা ও দলের তৃণমূলের অন্তত এক ডজন নেতা দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এদের মধ্যে ‘টাকার কুমির’ নেতার সংখ্যাই বেশি। তারা অনেকেই দলের শক্তির চেয়ে নিজের এলাকায় ব্যক্তি শক্তির বৃদ্ধির রাজনীতি করেছেন গত ১৪ বছর ধরে। এদের মধ্যে ২০১৩ সালের পরে অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নেতা হওয়া অংশটিই বেশি। এরা দলের চেয়ে নিজের শক্তি বৃদ্ধির রাজনীতিই করেছেন। ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তারা হচ্ছেন ‘আওয়ামী লীগ’ বনে যাওয়া নেতা। ছোট একটি অংশ রয়েছে, যারা দলের প্রতি ‘কমিটমেন্ট’ থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হওয়া নেতা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, এ ধরনের আভাস পেয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ভিন্ন প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে শুরু করেছে। সারা দেশে এ সংখ্যা কত এবং তাদের দুর্বলতা কী, সেসব তথ্য নিয়ে রাখা হচ্ছে। এ ধরনের প্রার্থী হলে দুর্বলতা হিসাব করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এজন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), প্রশাসন রয়েছে যাকে যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে কাজে লাগানো হবে।

দলের আরেক সভাপতিমন্ডলীর সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রথমেই রাজনৈতিক পথ অনুসরণ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হবে। এজন্য জুলাই মাস থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচন নিয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন ওই বৈঠকগুলোতে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, তারা আগে দলীয় মনোনয়ন পেতে সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। সেই চেষ্টায় সফল না হলে তারা টাকা ছড়াবেন। তারা মনে করেন ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’। তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাকার মেশিন এসব নেতা মনে করেন দল মনোনয়ন না দিলে সেই টাকা এলাকার ভোটারদের বিলিয়ে সংসদ সদস্য (এমপি) হওয়া সম্ভব। টাকার শক্তিতেই মূলত দলের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন তারা।

দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা বলেন, আগামী নির্বাচনেও মেশিনম্যানদের ভিড়ে দলের নির্যাতিত-নিপীড়িত, ত্যাগীদের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দলের ভেতরের শীর্ষ পর্যায়ের একটি অংশের নেতারা টাকাওয়ালা নেতাদের পক্ষে দাঁড়াবেন। গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের মা যে কায়দায় মেয়র হয়েছেন, সেই ভীতি দেখিয়ে মনোনয়ন বোর্ডকে প্রভাবিত করবেন। সেসব নেতা আরও জানান, নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে জিততে হবে এমন একটি আলোচনা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। সেজন্য টাকার কুমির বনে যাওয়া নেতারা মনোনয়নও পেতে পারেন। শেষ পর্যন্ত এ হিসাব কষলে রাজনীতি করা নেতাদের আবারও স্বপ্নভঙ্গ হতে পারে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, যোগ্যতার নির্ধারিত মানদ- রয়েছে। দল করলে দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে। এটাই শেষ কথা।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রার্থী বদলানোর এক ধরনের সিদ্ধান্ত থাকলেও এবারের নির্বাচনেও টাকাওয়ালাদের মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দলের তহবিল থেকে টাকা দিয়ে নির্বাচন করা নেতাদের মনোনয়ন কম দেওয়া হতে পারে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থী বদলানোর যে ইঙ্গিত দলীয় সভাপতি একাধিকবার দিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন নাও ঘটতে পারে।

দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের মূল্যায়নে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থী টাকার মালিক কি না, সেটাও বিবেচনায় নেওয়া হবে। ফলে শুধুই পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ও ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসছে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতীতের বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, বিদ্রোহী প্রার্থী হলে শাস্তির আওতায় আসতে হবে ওই প্রার্থীকে দফায় দফায় এটা বলা হলেও শাস্তির নজির সৃষ্টি করতে পারেনি দল। ফলে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করার সাহস ধীরে ধীরে বেড়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের সেই সাহস আরও বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন এ নেতা।

তিনি বলেন, একটা সময়ে যেকোনো দল থেকে এলেই আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। দল শক্তিশালী হবে ভেবে আওয়ামী লীগের নেতারা সেটা মেনে নিয়েছেন। অনেকটা পাল্লা দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান অনুষ্ঠান করেছে। কয়েক বছরের মধ্যেই নতুনরা দলের বিভিন্ন স্তরে পদ পেয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়নও পেয়েছেন। এখন তারাই জটিলতার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাদের একটা অংশ এমপিও হয়েছেন। এবারও মনোনয়ন পাওয়ার আশা করছেন।

ওই নেতা আরও বলেন, গাজীপুরের নজির মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণে চাপ সৃষ্টি করবে। দলের ভেতরে থাকা একটা অংশ গাজীপুরকে উদাহরণ টেনে টাকাওয়ালা নেতাদের পক্ষ নেবে। প্রার্থী পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে চাপে ফেলবে সেসব নেতা। ফলে টাকাওয়ালা ও এলাকার ব্যক্তি প্রভাব বিস্তার করা নেতারাই এবারের জাতীয় নির্বাচনে ছক্কা হাঁকাতে পারেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের স্বার্থে সিদ্ধান্ত মানতে হবে সবাইকে। এরপরও দলীয় ফোরামে কথা বলার সুযোগ তো থাকবেই তাদের।’ তিনি বলেন, ‘এবারের মনোনয়ন দেওয়া হবে যারা নির্ধারিত মানদন্ডে উন্নীত হবেন, তাদেরই। মূল কথা, দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতারাই নৌকা পাবেন।’



বার্তা সূত্র