চলতি সপ্তাহে ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ সিনেমাটি দেশে সর্বোচ্চ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাটির পরিবেশনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া জানিয়েছে, ১৩৭টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। এর আগে শতাধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’, এর আগে অনন্ত জলিলের ‘দিন : দ্য ডে’। তবে এই ছবিগুলো ঈদকেন্দ্রিক। ব্যতিক্রম হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক। সিনেমাটিই উৎসবের বাইরে শতাধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার রেকর্ড তৈরি করে।
দেড় হাজার থেকে কমতে কমতে বর্তমানে নিয়মিত সিনেমা হলের সংখ্যা এখন ৪৬টিতে দাঁড়িয়েছে। এমন মৃতপ্রায় প্রেক্ষাগৃহের সময় বায়োপিকটির এতগুলো প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া কম চমক নয়। কিন্তু উৎসবের বাইরে এই সুযোগ ভবিষ্যতে আর কোনো সিনেমার পক্ষে জুটবে!
তবে প্রেক্ষাগৃহের আকালে সেটা বৃদ্ধির সরকারি উদ্যোগ মুখ থুবড়ে থাকলেও একটি বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা বাড়ানোর। অন্যান্য হল মালিকরা যেখানে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে একে একে তাদের প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ করে দিচ্ছে, সেখানে স্টার সিনেপ্লেক্সই এমন ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে; যারা গত ২০ বছরে তাদের সিনেপ্লেক্স ১৯টিতে উন্নীত করেছে। অর্থাৎ গড় হিসাবে বছরে একটি সিনেপ্লেক্স বাড়িয়েছে তারা। যা আগামী বছরে ৪০টিতে উন্নীত হবে জানিয়েছে তারা।
মাল্টিপ্লেক্স চেইন স্টার সিনেপ্লেক্স সম্প্রতি তাদের ২০ বছর পূর্তিতে এমন ঘোষণা দিয়েছে যে, সারা দেশে তাদের সিনেপ্লেক্সের শাখা আরও ১০০টি করবে। এ উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহবুব রহমান তার ঘোষণায় জানান, ‘একটা সময় আমাদের অনেক সংগ্রাম করে সিনেপ্লেক্স চালু করতে হয়েছে। দর্শকদের নিয়ে আসতে হয়েছে। এখন দর্শকরা নিয়মিত সিনেমা দেখছেন। সিনেপ্লেক্সের পরিসর বাড়ছে। ঢাকা ছেড়ে বিভাগীয় ও জেলা শহরে পৌঁছে যাচ্ছে এর শাখা।’
এর মধ্যে তারা সিনেমা প্রযোজনায় যুক্ত হয়েছেন, যা তাদের উৎসাহিত করেছে। তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালে আমাদের শুরুটা ইংরেজি ভাষার সিনেমা দিয়ে হয়েছে। পরবর্তীতে দেখেছি, বাংলা সিনেমার অনেক দর্শক রয়েছে। এমনও হয়েছে, হলিউডের অনেক সিনেমার সঙ্গে বাংলা অনেক ছবি ভালো ব্যবসা করেছে। এ অবস্থায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ২০টি স্ক্রিন চালু করব। আমরা শিগগিরই কক্সবাজার, ঢাকার উত্তরা, নারায়ণগঞ্জ এবং বগুড়াতে একাধিক স্ক্রিনের সিনেপ্লেক্স চালু করতে যাচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য ১০০ স্ক্রিন চালু করা।’
সরকারি উদ্যোগের মতো শুধু ঘোষণা দিয়েই থেমে নেই তারা। এখন রীতিমতো এই সংখ্যা বাস্তবায়নে কাজ করছে তারা। ব্যক্তি উদ্যোগের এমন নজীর আর কোনো হল মালিকেরই নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, স্টার সিনেপ্লেক্স যদি একটি প্রেক্ষাগৃহ থেকে ১০০টির বেশি প্রেক্ষাগৃহে উন্নীত করতে পারে, অন্যরা পারছে না কেন? এমনকি সরকারি উদ্যোগও কেন সাফল্য পাচ্ছে না? এ জন্য যে অদম্য মনোভাব থাকা দরকার, সেটা স্টার সিনেপ্লেক্স করোনাকালীন দুর্যোগেও দেখিয়েছে। যখন প্রেক্ষাগৃহ হঠাৎ মড়ক লাগার মতো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
এ সময় সংকটের কথাও তুলে ধরে মাহবুব জানান, ‘ট্রাফিক ঠেলে দর্শকদের সিনেমা হলে নিয়ে আসা কঠিন। করোনার সময় তারা ভেবেছিলেন, ‘সিনেমা হল টিকে থাকতে হিমশিম খাবে। দর্শকদের সিনেমা হলমুখী করা কঠিন হবে। কিন্তু পরবর্তী সময় দর্শকরা আবার হলমুখী হয়েছেন।’
দর্শক আবার হলমুখী হচ্ছেনÑ এটা বোঝা যাচ্ছে গত দুই বছরে কয়েকটি ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য দেখে। এই সাফল্যগুলোর দিকে তাকালেও বোঝায় যায়, দর্শকের রুচি এখন কোন দিকে যাচ্ছে। মাহবুব রহমান জানান, ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’ এরকম মানের কন্টেন্টের সিনেমা বছরে অন্তত ১০টি হতে থাকলে প্রেক্ষাগৃহ আরও বাড়তে থাকবে। এখন বছরে অন্তত দুটি হচ্ছে- এই সংখ্যা ১০-এ উন্নীত হলে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সুবাতাস বইতে থাকবে, এতে কোনো সংশয় নেই। সেটার আঁচও পাওয়া যাচ্ছে নতুন নির্মাতাদের হাত ধরে বানানো সিনেমার কন্টেন্টে।
এখন এই সাফল্য ধরে রাখতে জরুরি হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি উন্নত মানসম্পন্ন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের। এর মধ্যে শুক্রবার মুক্তি পাওয়া ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ সিনেমার কলাকুশলীদের এক নৈশভোজের আয়োজনে প্রধানমন্ত্রী নিজেও দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলো সংস্কার ও আবার চালু করার জন্য সংশ্লিষ্টদের ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন।
এখন দেখার বিষয়, সংশ্লিষ্টরা কতটা আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছেন। স্টার সিনেপ্লেক্সের মতো বেসরকারি উদ্যোগে যেমন আন্তরিকতা রয়েছে, সেটা তারা দেখাতে পারছে কিনা। এর আগে সরকার চলচ্চিত্রের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে একটি নির্ধারিত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সিনেমা হলগুলোর জন্য গঠিত এক হাজার কোটি টাকার অর্থায়ন তহবিলের ঋণদানের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে হল মালিকদের মধ্যে যেমন সাড়া পড়বে মনে করা হয়েছিল, সেটা একদমই হয়নি। ফলে সরকার ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত এক সার্কুলার জারি করে সেটার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের ঋণদানের সময়সীমা সে বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছিল। সেই সীমা কবেই পেরিয়েছে। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তহবিলের সিংহভাগ অর্থ এখনো অব্যবহৃত রয়েছে হল মালিকদের অনাগ্রহের কারণে। হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ অথচ চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র পাঁচ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে! খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত ব্যাংকের নির্ধারিত শর্তাবলী পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই এই ঋণ বিতরণ সম্ভব হচ্ছে না। এখন হল মালিকদের দাবি অনুযায়ী, যদি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হয়, তবে ব্যাংকের শর্তাবলী শিথিল করতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নের।
উল্লেখ্য, সার্কুলার অনুযায়ী, সিনেমা হল সংস্কার, আধুনিকায়ন ও নতুন হল নির্মাণে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে। নতুন একটি ইউনিট স্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা এবং বিদ্যমান একটি ইউনিট সংস্কারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে। এই ঋণ শোধ করার সময়সীমা আট বছর।
যাযাদি/ এস