Skip to content

বিপরীত ভাবমূর্তির খোঁজে চীন

বিপরীত ভাবমূর্তির খোঁজে চীন

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে বিশ্বের সাধারণ মানুষ কীভাবে দেখে– এমন প্রশ্নের জবাব একেক দেশ বা অঞ্চলে একেক রকম। মার্কিন বলয়ের দেশগুলোর কাছে চীন গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা ব্যবসায়ী দেশ। তারা হংকংয়ে পুতুল সরকার বসিয়েছে; তাইওয়ানের ওপর নিয়ন্ত্রণ চালাতে চায়; দক্ষিণ চীন সাগরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সক্রিয়। নিজ দেশে সংখ্যালঘু উইঘুরদের ওপর নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কারও কারও কাছে চীন শুধুই বাণিজ্য সম্প্রসারণকারী দেশ। আফ্রিকা থেকে লাতিন আমেরিকা– কোথায় পাওয়া যায় না চীনের পণ্য। কিন্তু সম্প্রতি চীন যে কারণে আলোচনায় এসেছে, তা হলো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের ভূমিকা।

সৌদি-ইরান চুক্তি কার্যত তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। গত ১০ মার্চ বেইজিংয়ে চীনের মধ্যস্থতায় টানা কয়েক দিনের ধারাবাহিক বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে এ চুক্তি হয়। ৬ এপ্রিল তাদের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয়, যেখানে দুই দেশ পুনরায় ফ্লাইট চালু, দূতাবাস খোলাসহ যোগাযোগ স্বাভাবিক করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বিবদমান এ দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার ইতিবাচক ফল এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে উপসাগরীয় অন্য দেশগুলো। তারা নিজেদের মধ্যে বৈরিতার অবসান ঘটাতে এগিয়ে আসছে।

২০১৬ সালে সৌদিতে শিয়া নেতা নিমর আল নিমরের ফাঁসি কার্যকর হলে ইরানে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। হামলা হয় তেহরানে সৌদি দূতাবাসে। এর জেরে দূতাবাস বন্ধ করে দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে রিয়াদ থেকে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরে যেতে বলে। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে।

দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছে। আঞ্চলিক যেসব দেশ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটিকে সমর্থন করে পক্ষাবলম্বন করায় মধ্যস্থতাকারী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। ইয়েমেন যুদ্ধে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইরত সৌদি জোটকে অস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া নানা ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। অন্যদিকে উভয় দেশের সঙ্গেই উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে চীনের। তারা এটাকেই কাজে লাগিয়েছে। সৌদি-ইরান চুক্তি নিশ্চিতভাবে চীনের জন্য বিশাল বিজয়, যা তাদের নতুন এক ভাবমূর্তি দিয়েছে।

চীনের এ দূতিয়ালির ফলস্বরূপ ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রইসিকে সৌদি সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রিয়াদে সাত বছর পর খুলেছে ইরান দূতাবাস। ২০১১ সালের পর প্রথমবারের মতো রিয়াদ সফর করেছেন সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সল মেকদাদ। তাঁদের মধ্যে বৈঠকের পর সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তারা আবারও নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করতে যাচ্ছে। শিগগিরই দূতাবাস ও ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কয়েকশ হুতি বিদ্রোহীকে কারামুক্ত করেছে সৌদি। পাল্টা হুতিরাও বেশ কয়েকজন সৌদি নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে।

এদিকে এ সফলতার প্রেক্ষাপটে চীন এবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবসান দেখতে চায়। মনে রাখতে হবে, রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও ইউক্রেনের সঙ্গে চীনের বড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। দেশটির মিকোলাইভ বন্দর নির্মাণ করেছে চীন। এ ছাড়া কিয়েভের সাবওয়ের মতো বড় প্রকল্পের কাজও করেছে চীনের কোম্পানি।

সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। এর পরই যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার আশার পালে হাওয়া লাগে। অনেকে ধরে নেন, চীন এবার ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী হতে পারে। কার্যত চীনকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় দেখতে চান ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁও। চলতি মাসে বেইজিং সফরকালে তিনি চীনের নেতাকে বলেছেন, রাশিয়াকে যুক্তির ভেতরে নিয়ে আসা এবং সবাইকে আলোচনার টেবিলে বসানোর বিষয়ে তিনি শি জিনপিংয়ের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন। জবাবে শি বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করবেন। সেই সঙ্গে চীনের নেতা জানান, এ রকম একটি সরাসরি যুদ্ধে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় যেতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের কারণে তিনি পিছপা হবেন না।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ চলছে ইউক্রেনে। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে। এ কারণে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বৈরী। কোনোভাবেই তারা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আসতে পারছে না। তবে চীন এ ক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ‘সীমাহীন বন্ধুত্ব’। কিন্তু তারা রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না, যে কারণে ইউক্রেন তাদেরকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অস্বীকার করতে পারে। অর্থনীতির জন্য ইউক্রেনকেও প্রয়োজন বেইজিংয়ের। চীনের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম গন্তব্য ইউক্রেন।

মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনকে মেনে নিয়েছে ইউক্রেনও। গত রোববার ইউক্রেনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি মেলনিক জানান, চীনারা তাদের নিজেদের স্বার্থটা দেখছে। তবে শান্তিপূর্ণ সমাধান ও সংঘাতের অবসানও বেইজিংয়ের স্বার্থের অন্তর্ভুক্ত।

১৯৯৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রচেষ্টায় কসোভো যুদ্ধের অবসান হয়। সে সময় তাঁর সুপারিশে ন্যাটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) হামলার মুখে যুগোস্লাভিয়ার বাহিনী কসোভো ছাড়তে বাধ্য হয়। পরবর্তী দুই দশকের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে ৯/১১-তে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলা বদলে দিয়েছে সার্বিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। চলমান বিশ্বব্যবস্থায় সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে এগোচ্ছে চীন। তাদের এ অগ্রযাত্রা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে যুক্তরাষ্ট্রকেও। চীন নতুন ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টায় সক্রিয়। এটা তাদের মুখও হতে পারে, আবার মুখোশও।

তুহিন তৌহিদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল



বার্তা সূত্র