Skip to content

বাংলাদেশ সফরে আসছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

বাংলাদেশ সফরে আসছে মার্কিন প্রতিনিধিদল

‘আওয়ামী লীগের এখনকার রাজনীতি ও নেতাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার কৌশল আয়ত্ত করতে পারিনি। ঘরে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় কী?’ এমন আক্ষেপ শোনা গেছে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমের নেতৃত্বাধীন যুবলীগের কমিটির সম্পাদকীয় পদের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার বক্তব্যে। গত মে মাসে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ের বাইরে তার সঙ্গে দেখা হয় দেশ রূপান্তরের এ প্রতিবেদকের। তিনি বলছিলেন, ‘আট বছর হলো রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই।’

একসময় সবার পরিচিত যুবলীগের সাবেক কমিটির এ গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মকাণ্ডে দেখা যায় না। বর্তমান রাজনীতি ও নিজের নিষ্ক্রিয়তার বিষয়ে তিনি বলছিলেন, ‘বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, এমন লোককে যখন দেখি দল বদলে আওয়ামী লীগে পদ পেয়ে গেছে, যখন দেখি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে জনপ্রতিনিধিও হয়ে গেছে নৌকা প্রতীক নিয়ে, তখন মেনে নিতে কষ্ট হয়।’

আলাপচারিতায় এ নেতার সর্বশেষ বক্তব্য হলো, ‘দুর্দিনেও আর মাঠে নামব না। শারীরিক-মানসিক শক্তি পাই না এখন।’ ২০০৩-০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের চরম অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার ও জেলখাটা ছাত্রলীগের এক নেতাকে এখন গন্তব্যহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বলছিলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ১৪ বছর পার হলেও ক্ষমতার স্বাদ পাননি তিনি। ছাত্রলীগ ছাড়ার পর ত্যাগী এ ছাত্রনেতা অন্য কোনো সহযোগী সংগঠন বা মূল দলের কোনো স্তরেই পদ-পদবি পাননি। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতা চাই না। রাজনীতি করব, সেই সুযোগও পাই না। সবকিছুই আজব লাগে।’

এ দুই নেতার মতোই সারা দেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর কাছেই ক্ষমতাসীন দলটিকে এখন অচেনা লাগে। কারও কারও মতে, ‘আওয়ামী লীগকে এখন আজব লাগে।’ এ অংশটি এখন ঘরে উঠে গেছে।

এ প্রতিবেদক যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। তারা বলেছেন, নাম প্রকাশ করলে সান্ত¡না পাওয়ার বদলে ভর্ৎসনা আর অপমানই জুটবে।

সারা দেশে আওয়ামী লীগ করা নেতাকর্মী-সমর্থক ও অনুসারীর সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও যুবলীগ, ছাত্রলীগের এ দুই নেতার মতো ক্ষমতার ১৪ বছরে অন্তত ২০ লাখ নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। তাদের প্রায় সবাই বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার পথ অনুসরণ করে রাজনীতি করা।

আওয়ামী লীগের দপ্তর সূত্র বলছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ১৪ বছরে অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন অসংখ্য লোক।

দলীয় ও সরকারি একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিষ্ক্রিয় অধিকাংশ নেতাকর্মী ক্ষমতা ও অর্থের প্রভাব দেখানো একটি অংশের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেননি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন জেলায় বিএনপি-জামায়াতের অনেকেই প্রকাশ্যে দল বদল করেছেন। দল বদলানো লোকজনকে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দেওয়া নিয়ে দলেরই ভেতরে নানা সমালোচনা হয়।

২০১৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি এ প্রতিবেদক অন্য একটি সংবাদমাধ্যমে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় তিনি তার এক বিশেষ প্রতিবেদনে ডিগবাজি খেয়ে আওয়ামী লীগে আসা নেতাকর্মীদের ব্যাপারে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘হাইব্রিড’, ‘কাউয়া’ ও ‘ফার্মের মুরগি’ আখ্যায়িত করে দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যের কারণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছেন। ক্ষেত্রবিশেষে সমালোচিতও হয়েছেন। নব্য ও সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগারদের উদ্দেশে এসব বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন তিনি।

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার একটি ইউনিয়ন শাখা আওয়ামী লীগের সদস্য ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের দুই মেয়াদের চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে বিএনপি করতেন তিনি। ওই দলের তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্যের হাত ধরেই তিনি এলাকার রাজনীতিতে প্রভাব খাটাতে শুরু করেছিলেন। এখন তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী রাজনীতিকদের আশীর্বাদপুষ্ট। বর্তমান মেয়াদে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হয়েছেন। তার মতো অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধি এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী। তাদের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন দলের পুরনো ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা, যাদের অর্থ-বিত্তের জোর নেই।

কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দুর্দিনে রাজনীতি করা নেতাদের কদর কই? আমি রাজনীতি করেছি একটি আদর্শ ও লক্ষ্য সামনে রেখে। কিন্তু ২০০৮ সালে দল ক্ষমতায় আসার পর আমার মতো নেতাকর্মীদের কদর আর নেই। গত ১৫ বছরে দলের কোনো স্তরেই রাজনীতি করার সুযোগ আর পাইনি। অথচ ২০০১ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াতের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছি। কিন্তু ওই দুই দলের অনেকের জায়গা হয়েছে আওয়ামী লীগে। তাদের সম্মান দিয়ে দলে যোগদান করানো হয়েছে। যারা আমাদের দলের নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময় মেরেছে, দলে পদও পেয়েছে তারা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত হয়ে গেছে। এগুলো দেখে রাজনীতি করার আগ্রহ শেষ হয়ে গেছে।’

সাবেক এ নেতা আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যে “আওয়ামী লীগের” জন্ম দিয়েছে, তাদের কাছে আমাদের রাজনীতির আজ আর কোনো প্রয়োজন পড়ে না।’

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ক্ষমতার ১৪ বছরে সারা দেশের গ্রামেগঞ্জে ‘দাপুটে’ আওয়ামী লীগের সৃষ্টি হয়েছে। যারা সবসময়ই সরকারি পার্টি। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভেতরে অনেকেই “দাপুটে” আওয়ামী লীগকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। সেটা সংগঠনের উপকারে আসেনি। ব্যক্তিক্ষমতা বেড়েছে। ব্যক্তিক্ষমতার শক্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় আদর্শ অনুসরণ করা নেতাকর্মী তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। তাই সারা দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতাকর্মী নিষ্ক্রিয় হতে হতে ঘরে উঠে যেতে বাধ্য হয়েছে।’

জানা গেছে, দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাকে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা ২০ লাখ নেতাকর্মীর নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে ওইসব নেতাকর্মীকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলা না গেলে মাঠপর্যায়ে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ সময় দলে ক্ষমতা প্রদর্শন করা নেতাদের হুঁশিয়ার হয়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছে, দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেসব নেতাকর্মীর জন্য আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায়। তাদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদী কাউকে দলে দরকার নেই। যারা ত্যাগ স্বীকার করে যুগের পর যুগ দলকে টিকিয়ে রেখেছে, সেসব নেতাকর্মীকে যারা অবমূল্যায়ন করেছে, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সময়মতো তারা শাস্তি পাবে।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, যারা ক্ষমতা পেয়েছেন, সংসদ সদস্য (এমপি) হয়েছেন, বিভিন্ন পদ-পদবি পেয়েছেন, তারা গত ১৪ বছর দলের ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের অবহেলা-অসম্মান করেছেন। ক্ষমতা পেয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি শক্তিশালী করতে কাছে টেনে নিয়েছেন সুবিধাবাদী ও বিএনপি-জামায়াত থেকে আসা পরগাছাকে। অবমূল্যায়িত হয়ে রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-কষ্টে দল ও দলের রাজনীতি ছেড়ে ঘরে ফিরে গেছে ওই অংশটি।

এমনই একজন কুমিল্লার একটি থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, যিনি জেলা ছাত্রলীগেরও সহসম্পাদক এবং উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শুধু রাজনীতি নয়, দেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন প্রবাসে। তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যিনি ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এখনো ওই ইউনিয়নে তাদের আওয়ামী পরিবার হিসেবে জানে সবাই। বর্তমানে প্রবাসী ওই সাবেক ছাত্রনেতা বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারুণ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন দীর্ঘদিন। জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের বলয়ের রাজনীতি করতেন। ওই নেতার মৃত্যুর পর সেখানে সংসদ সদস্য হন আরেকজন। পূর্ববর্তী সংসদ সদস্যের বলয়ের রাজনীতি করতেন বলে বর্তমান সংসদ সদস্য তাকে রাজনীতি করার সুযোগ তো দেনইনি, উল্টো তার পরিবারের ওপর এলাকার নব্য আওয়ামী লীগারদের দিয়ে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছেন। যে কারণে রাগে-অভিমানে সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে প্রবাসে চলে গেছেন। তাদের পারিবারিক যে গ্রহণযোগ্যতা এলাকায় রয়েছে, তাতে চাইলেই অন্য যেকোনো বড় রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারতেন, কিন্তু রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না বলে সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছেন সাবেক ওই ছাত্রনেতা।

দলীয় ও সরকারি একাধিক সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ একটি উপায় অনুসরণ করে দলের নিষ্ক্রিয় এমন নেতাকর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কেন তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন, কারণগুলো খুঁজে বের করেছেন তিনি। সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশন শেষ হলেই তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবনে এসব নেতাকর্মীকে ডাকবেন। তাদের মান ভাঙাবেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবেন দলীয়প্রধান। একই সঙ্গে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণেরও নির্দেশনা দেবেন তিনি।



বার্তা সূত্র