দেশে সর্বশেষ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে, গত শুক্রবার। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সেখানে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক ধর্মীয় জমায়েতকে (সালানা জলসা হিসেবে পরিচিত) কেন্দ্র করে তাঁদের ওপর চালানো হামলায় দু’জন প্রাণ হারিয়েছেন। ৩০ জন আহত এবং ৮০টি ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। শুধু পন্থাগত পার্থক্যের কারণে হামলার শিকার এসব মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ায় অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই। জলসা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পঞ্চগড়ে আগতরাও ভয়ে চলে গেছেন। অন্যেরাও ভয়ে মুখ খুলছেন না।
মনে রাখতে হবে, এটি হঠাৎ পাওয়া ভয় নয়। কারণ, এ দেশে আহমদিয়াদের ওপর এ ধরনের হামলা এই প্রথম নয়; নব্বই দশক থেকে বিভিন্ন এলাকায় অনেকবার হামলা হয়েছে। বিশেষত বকশীবাজারে তাঁদের প্রধান কেন্দ্র এবং মসজিদে কয়েক দফা হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তেজগাঁও এলাকায় তাঁদের মসজিদ দখলের চেষ্টা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০১৫ সালের কথা ভুলে যাওয়া কঠিন। সেই বছর ডিসেম্বরে রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়েছিলেন। এমনকি ২০১৯ সালেও পঞ্চগড়ে এ ধরনের হামলা হয়েছিল। সে বছরও একই ধরনের বার্ষিক জলসা আয়োজনের সময় হামলা চালানো হয়েছিল। তাঁদের বাডি়ঘর ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গত বছরও টানটান উত্তেজনা ছিল পঞ্চগড়ে বার্ষিক সালানা জলসা আয়োজনকে কেন্দ্র করে। তখনও একাধিক ইসলামী সংগঠন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে আপত্তি তুলেছিল এবং হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। তবে গত বছর প্রশাসন সচেষ্ট ছিল। তাই হামলা এড়ানো গেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পঞ্চগড় ছাড়াও গত ৩০ বছরে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, শেরপুর, নাটোর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর একাধিকবার হামলা হলেও কোনোটির বিচার হয়নি।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আহমদিয়া জামাতের পাঁচশরও বেশি মসজিদ রয়েছে। বকশীবাজার, তেজগাঁও ছাড়া পঞ্চগড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, জামালপুরে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি এবং এ জন্যই এ জেলাগুলোতে তাঁদের ওপর হামলা বেশি হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, গত ৩০ বছরে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেই হামলা যে শুধু অমুসলিম ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং নারীর ওপর হয়েছে; এমন নয়। আহমদিয়াদের ওপর হয়েছে, হচ্ছে। এমনকি ব্লগারদের হত্যা করা হয়েছে। যাঁরা গানবাজনা করেন, সুফি সাধক, বাউল; তাঁদের ওপরেও আক্রমণ হচ্ছে।
লক্ষণীয়, এ ধরনের হামলা নিয়ে দেশে খুব বেশি প্রতিবাদ হয় না। কারণ এসব প্রতিবাদে নানা ঝুঁকি আছে বলে অনেকেই মনে করেন। অথচ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া জরুরি– সাম্প্রায়িক হামলা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতার অঙ্গীকারের পরিপন্থি। কোনোভাবেই কারও ধর্ম পালনের অধিকার হরণ করা যায় না এবং যাবে না। কিন্তু শুধু ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার– এ ধরনের স্লোগান দিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে কাজ হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড় অহংকার ও আত্মত্যাগের ইতিহাস যে রাষ্ট্রের রয়েছে, সেই বাংলাদেশে কেন বারবার সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটছে? এর কারণ সাদা চোখেই দেখা যায়। আজ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক হামলার কোনোটির বিচার হয়নি। এতে একদিকে হামলাকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে, অন্যদিকে বিচার না পেয়ে হামলার শিকার মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। তাঁদের প্রতিদিনকার জীবনের সঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার ভয় জড়িয়ে যায়।
এ ধরনের হামলা অনেক অধিকারের অস্বীকৃতি। প্রথমত, আক্রান্তের ধর্মীয় মতপ্রকাশ ও চর্চার অধিকারকে অস্বীকার করা হয়; দ্বিতীয়ত, হামলার বিচার না হওয়া মানে তাঁদের বিচার পাওয়ার অধিকারকে খর্ব করা হয়; এবং শেষত, নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারের অকার্যকারিতা।
জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। ইতোমধ্যে দুই দলই ধর্মকে নির্বাচনে জেতার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল নিচ্ছে। প্রতিবার তা-ই হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতি নির্বাচনে এবং রাজনীতিতে ব্যবহারের তাগাদাই আসলে দার্শনিকভাবে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
আমাদের প্রয়োজন হয়তো অনেক কিছুই। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক হামলাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে তারপর এগোনো। এ দায়িত্ব প্রথমত রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এসব হামলা সংক্রান্ত মামলার বিচার অতি দ্রুত করতে হবে। হামলা ঘটলে তদন্ত কমিটি হয়। তারপর সেই তদন্ত কমিটি কী করে, বিপোর্ট কোথায় যায়, সে বিষয়ে আর কিছুই জানা যায় না।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ– ধর্ম নিয়ে রাজনীতি না করে এটি যেন মানবিকতার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবহার না করে, সে বিষয়ে কথা বলুন এবং বিশেষ আইন পাসের দাবি জানান। মানবিক সম্পকের্র উন্নয়ন না ঘটলে, দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধ না হলে কোনো উন্নয়নই কাজে আসবে না।
জনগণের কী করণীয়? আমাদের আছে অনেক কিছু করার। সাধারণ মানুষও কিন্তু অন্যের নিরাপত্তা হয়ে উঠতে পারে। পঞ্চগড় থেকেই আমার এক বন্ধু জানিয়েছেন, আক্রান্তদের সহায়তা করতে গিয়েছেন বলে তাঁর আত্মীয় অনেকেই কথা বলা বন্ধ করেছেন। তাই অনেকেই ভয়ে যাচ্ছেন না।
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের দায়িত্ব বেশি। কারণ তাদের অনুভূতিকে পুঁজি করেই অন্যরা এ ধরনের ক্ষমতা চর্চার আশকারা পায়। তাই আদেরই সবার আগে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং আক্রান্তদের পাশে থাকতে হবে।
হতাশা ও বিক্ষুব্ধতার জায়গা হলো, এখন পর্যন্ত আক্রান্তরা আশ্বস্ত হতে পারছে না– ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা আর হবে না। এই পরিস্থিতি আমাদের অনেক বার্তাই দেয়। যে বার্তা মোটেই শান্তির জন্য নয়; স্বস্তির নয়।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক
zobaidanasreen@gmai.com