Skip to content

নির্বাচন নিয়ে সংখ্যালঘু উদ্বেগ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। সবকিছু ঠিকঠাক চললে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে প্রায় দুই বছর ধরে। প্রতিদিনই বিএনপি মিটিং-মিছিলে থাকলেও, অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামী সম্ভবত কৌশলগত কারণে রাজনীতির ময়দানে অনেকটাই অনুপস্থিত। তবে বহুধাবিভক্ত বামপন্থি বা মধ্য-বামপন্থি একাধিক রাজনৈতিক দলও বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সরব থাকার চেষ্টা করছে, যদিও সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে তাদের জনভিত্তি প্রশ্নসাপেক্ষ। বিএনপি যদি আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে দলগুলো হয়তো জোটবদ্ধ নির্বাচনে যেতে পারে। কারণ এককভাবে নির্বাচনের ময়দানে ছোট দলগুলো বিশেষ সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কোনো কোনো দল জোট থেকে ছিটকেও যেতে পারে। বিরোধী দলের আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারি দলও ময়দানে রয়েছে। উভয়পক্ষের রাজনৈতিক ভাষা প্রয়োগ সাধারণ মানুষ কখনো কখনো কৌতুকবোধ করলেও, আগামী দিনের রাজপথের সংঘাত নিয়ে শঙ্কায়ও আছে। বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে নির্বাচনকেন্দ্রিক ভিসা নীতি ঘোষণা রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তা, সরকারি এবং বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, যারা ভোট জালিয়াতিতে সহায়তা, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো ও বাধাদান, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধাদান, রাজনীতিক, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে পরিকল্পিতভাবে বাধাদান করে, সেসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিসা নীতি প্রযোজ্য হবে। এরই মধ্যে ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি কিছু নাগরিকের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়ে দিয়েছে। ভিসা নীতি ঘোষণায় বিএনপি প্রাথমিকভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও ২২ সেপ্টেম্বরের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ঘোষণার পর এতে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে প্রতীয়মান। দীর্ঘদিনের আন্দোলন অতীতের ন্যায় সহিংস না হওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বের তরফ থেকে শক্ত ভাষায় যুক্তরাষ্ট্র্রের সমালোচনা করা হলেও ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি যে নেই, তা বলা যাবে না; অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার আগেই সরকারের পক্ষ থেকে আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার নামে নির্বাচনের আগে ঘোষিত ভিসা নীতির পেছনে বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভূ-কৌশলগত অবস্থানে থাকা বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখার গোপন এজেন্ডা কাজ করেছে। নির্বাচনের আগে ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রয়োগ একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বকে খাটো করে দেখা হচ্ছে কি না, তা নিয়েও অনেকের কাছে প্রশ্ন আছে। নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের ইমেরিটাস অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ব্রহ্মা চালানী মনে করেন, মার্কিন ভিসা নীতি গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক হবে না (চ্যানেল আই অনলাইন, ১৫ জুন ২০২৩)। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সাংগঠনিকভাবে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত মনে করেন, নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও যথারীতি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ঘোষিত ভিসা নীতি যদি মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি বা দলকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেয়, তাহলে তা সংখ্যালঘু জনগণের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সাম্প্রদায়িক শক্তি ১৯৭২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, জমিদখল, মঠ-মন্দিরে হামলা করে যাচ্ছে। ফলে ১৯৭১ সালের শতকরা ১৯ ভাগ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ২০২৩ সালে শতকরা ৯ ভাগে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের যে কোনো নির্বাচন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছে নির্যাতনরূপে সামনে এসে দাঁড়ায়। বিগত দিনে একাধিক জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে তাদের নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। নির্বাচন অনেককে দেশত্যাগেও বাধ্য করেছে। ৩০ সেপ্টেম্বর ৭১ টেলিভিশনে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রচারিত ‘সমীকরণ’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ফারজানা রূপা ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী ভোট-রাজনীতির জন্য ধর্মকে সামনে নিয়ে আসা বিএনপি-জামায়াত জোটের বরিশালের আগৈলঝাড়া-গৌরনদী থেকে কোটালীপাড়ায় আশ্রয় নেওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর এককালীন ছাত্রমৈত্রীর নেতা, পরবর্তী সময়ে বিএনপির সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপনের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছেন। ২০০৩ সালের ৮ মার্চ বাগেরহাট সদর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে রাতের বেলায় ঘরে ঢুকে সেজো ছেলে তপন ভট্টাচার্যকে হত্যা করা, সিজারিয়ানের মাধ্যমে মৃত সন্তান প্রসবের পরদিন তপন ভট্টাচার্যের স্ত্রী অনিমা ভট্টাচার্যকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা, ঠাকুরবাড়ির পার্শ্ববর্তী মুখার্জি বাড়ির দশ ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবারের আটজনকে পানির দরে জায়গাজমি বিক্রি করে দেশত্যাগে বাধ্য করা, বর্তমানে ওই বাড়িতে বসবাসরত উজ্জ্বল মুখার্জির আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া বা ২০১৪ সালের নির্বাচনে পর যশোরের ভৈরব নদের পাড়ে অভয়নগর মালোপাড়ায় হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের তথ্য বা ২০০২ সালে রামপালের ছবি রানী মণ্ডলকে বাসস্ট্যান্ড থেকে ধাওয়া দিয়ে বিএনপি অফিসে নিয়ে ধর্ষণ ও চুল কেটে দেওয়া এবং পানির বদলে মুখে প্রস্রাব করে দেওয়া বা ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদসংক্রান্ত রায়ের পর ঢাকেশ্বরী মন্দির, কক্সবাজারে আলী আকবর ডেইল, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, মিরসরাইয়ের হিন্দুঅধ্যুষিত গ্রামে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে পুড়িয়ে দেওয়া বা সাঈদীর রায়ের পর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের স্মরণ দত্তের মুখে নির্যাতন ও আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্নতার তথ্য তুলে আনা ঘটনাগুলো বৃহৎ হিমবাহের ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। দুঃখজনক হচ্ছে যে, যিনি রামপালের ছবি রানীর চুল কেটে দিয়েছিলেন, তিনি এখন দাপটের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযুক্ত আসামিরা এখন আওয়ামী লীগে, যেমনটা জহিরউদ্দিন স্বপনও প্রকাশ্যে রয়েছেন বিরোধী দল বিএনপিতে।

২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী নির্যাতনের ওপর ২০১১ সালে সাহাবুদ্দীন কমিশন যে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছেন, তার আলোকে ফারজানা রূপা বিভাগওয়ারি সংঘটিত ঘটনাগুলো তার সমীকরণ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছেন। রামু-নাসিরনগর-শাল্লা-সাঁথিয়া-মুরাদনগর-চাঁদপুর-কুমিল্লা-ফেনী-পীরগঞ্জ-নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনার বাইরেও ধর্মীয় অনুভূতি বা অন্য কোনো অজুহাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই অপশক্তিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নে উৎসাহিত করছে এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। সাংবাদিক রাজিব নূর যিনি একসময় জহিরউদ্দিন স্বপনের ছাত্রমৈত্রীর সহযাত্রী ছিলেন— তার ভাষায়, ১৯৯২ সালের দাঙ্গা হচ্ছে ঘরপোড়ার দাঙ্গা-নির্যাতনের দাঙ্গা আর ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর দাঙ্গা হচ্ছে ধর্ষণের মহোৎসবের দাঙ্গা। রানা দাশগুপ্তের ভাষায়, ‘আমি বিচারও পাব না, রাজনৈতিক দলও এগিয়ে আসবে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর শান্তির জন্য আসবেন। এভাবে কি শান্তি হয়?’ ফারজানা রূপা আসন্ন নির্বাচনের আগে যে তথ্যটি তুলে এনেছেন, তা সবার জন্য বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য একটি সতর্কবার্তা বলা যায়। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ে ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে কতটুকু সুরক্ষা দিতে পারবে, নাকি নিজ দেশের কৌশলগত আধিপত্য বজায় রাখার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পুনর্বাসিত করতে সহায়তা দেবে, তা সময়ই বলবে। কথায় আছে—‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’।

লেখক : সমাজকর্মী



বার্তা সূত্র