সুইডিশ রাজধানী স্টকহোমের প্রধান মসজিদের সামনে ঈদুল আজহার দিনে প্রকাশ্যে কোরআন শরীফে যিনি আগুন দিয়েছেন তিনি এক ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্যক্তি; তার নাম সালওয়ান মোমিকা। পাঁচ বছর আগে তিনি ইরাক থেকে সুইডেনে আসেন, এখন তিনি সুইডেনের নাগরিক। তিনি নিজেকে একজন নাস্তিক বলেও দাবি করেছেন। মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা-ওআইসি-এর সঙ্গে বাংলাদেশও এই ঘটনার নিন্দা করেছে।
সুইডেনে প্রকাশ্যে কোরআন পোড়ানো বা কোরআন ছিঁড়ে ফেলার কাজ মোমিকার আগেও অনেকে করেছে। এর আগে সুইডেনের মালমো শহরে স্ট্রাম কুর্স নামের একটি কট্টর ডানপন্থী সংগঠন কোরআন শরিফ পোড়ায়। স্ট্রাম কুর্স অভিবাসনবিরোধী ও ইসলামবিদ্বেষী। ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশকে তারা বাক স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত মনে করে। পশ্চিমা বিশ্ব যে বাক স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পশ্চিমের দেশগুলোতে বাক স্বাধীনতার স্বীকৃতি আছে বলেই খ্রিস্টধর্মের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ড্যান ব্রাউন লিখতে পারেন ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’। এই বইয়ের কাহিনীকে সিনেমায় রূপ দেয়া হয়েছে, অসংখ্য ভাষায় বইটি অনূদিতও হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অনেক কথাই বলা হয়েছে এই বইতে, এমন কী বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবি যিশু ম্যারি ম্যাগদালিনকে বিয়ে করেছিলেন এবং তাদের একটি কন্যাও ছিল; অথচ খ্রিস্টধর্মে বলা হয়েছে, যিশু বা ঈসা মসীহ অবিবাহিত ছিলেন। ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের নবির কুৎসা রটনার জন্য লেখকের কিন্তু বিচার হয়নি, তার কল্লা নেয়ার জন্য নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে কোন তরুণ ছুটেও যায়নি। কারণ ধর্ম নিয়ে পশ্চিমের লোকদের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তারা ধর্মকে ভেটিকান সিটিতে স্থানান্তর করে ধর্মমুক্ত নির্মোহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
২০১৫ সালে শার্লি এব্দো নামক ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকীতে নবি মুহাম্মদ (স.)-এর কার্টুন আঁকার কারণে ফ্রান্সে মুসলিম জিহাদিদের আক্রমণে অনেক লোকের জীবনহানি হয়। সরকার পত্রিকার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় পরবর্তীকালে ফ্রান্সের বাক স্বাধীনতাবিষয়ক একটি স্কুলের ক্লাসে নবি মুহাম্মদ (স.)-এর কার্টুন প্রদর্শনকারী শিক্ষকের শিরচ্ছেদ করে এক মুসলিম তরুণ, চলন্ত গাড়ি দিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করে এক মুসলিম ড্রাইভার। শুধু ধর্মীয় অনুভূতির কারণে এমন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি, এসব ঘটনার পেছনে কাজ করেছে রাজনীতিও। এসব ঘটনা ঘটিয়ে কট্টর ডানপন্থার দলগুলো ধর্মীয় অনুভূতির সুড়সুড়ি দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, নির্বাচনে অন্ধ ভোটের জোয়ারে জিতে যায়।
প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক কারণেই কোরআন পোড়ানো হয়, বাবড়ি মসজিদ ধ্বংস করা হয়, মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে মুসল্লিদের হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক কারণ না থাকলে শুধু গরুর মাংস ফ্রিজে রাখার জন্য ভারতে মুসলমানদের অসম্মান বা খোলা মাঠে জুমার নামাজে বাধা সৃষ্টি করা হতো না। সামান্য কারণে হিন্দু উগ্রপন্থীদের ধর্মীয় জিগির তোলায় ভারতের মুসলিমরা প্রতিবাদ করে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতিবাদ করাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সহ্য করতে পারে না বলে ভারতে হিন্দুত্ববাদী চেতনা জাগ্রত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশেও একই রাজনীতির খেলা চলছে; হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জোটবদ্ধ করে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক খেলা চলছে। সুইডেনেও মত প্রকাশের সুযোগটা গ্রহণ করছে কট্টর ডানপন্থীরা এবং মোমিকাকে ডানপন্থীরা যে ব্যবহার করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কোরআন পোড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিশৃঙ্খল আচরণ করবে এবং সেই সুযোগটাই নেবে বিভিন্ন দেশের ডানপন্থী দলগুলো। এই ঘটনাগুলো প্রগ্রতিশীল লোকগুলোকেও প্রভাবিত করে।কট্টর মুসলিমরা কার্টুন প্রদর্শনের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ফ্রান্সের শিক্ষকের শিরচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটালে ফ্রান্সের শুধু ডানপন্থী কট্টর লোকগুলো নয়, প্রগতিশীল মানুষগুলো সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে ঘৃণা পোষণ করেছে এবং ডানপন্থাকে সমর্থন করছে; এভাবেই অচিরে অভিবাসন ও মুসলিমবিরোধী ডানপন্থীরা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসবে।
বর্তমানে কট্টর ডানপন্থীরা ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বারবারই মুসলিমদের ব্যবহার করছে ক্ষমতায় যাওয়ার ঘুঁটি হিসেবে; বুদ্ধি কম বলে মুসলিমরাও তাদের ফাঁদটি বুঝতে পারে না, শুধু বুঝতে পারে সব পরাজয়ে ইহুদির ষড়যন্ত্র। নবিজির কার্টুন ছাপা হওয়ার পর ফ্রান্সে মুসলিম শিক্ষার্থীর মধ্যে ধর্মের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, নিহত শিক্ষকের স্মরণে ফ্রান্সজুড়ে এক মিনিট নীরবতা কর্মসূচিতে কিছু মুসলিম শিক্ষার্থী অংশ নেয়নি। মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের এই আচরণ ফ্রান্সের জাতীয় ঐক্য নষ্ট করেছে। তাই বোধহয় যারা কার্টুন আঁকার পর শার্লি এব্দোর বাড়াবাড়িতে নাখোশ ছিল তারাই আবার শিক্ষকের শিরচ্ছেদে প্রতিবাদ করেছে। ইসলামের কট্টরপন্থার মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর সরকারের ওপর তারা প্রবল চাপও সৃষ্টি করেছিল। শুধু সুইডেন বা ফ্রান্স নয়- বাক স্বাধীনতার বিশ্বাসী, ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাশীল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি দেশেও ক্রমান্বয়ে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটছে।
সালওয়ান মোমিকার মতে কোরআন হচ্ছে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও নারী অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তাই কোরআন নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও নারী অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আরও অসংখ্য বই এবং ধর্মগ্রন্থ রয়েছে, কিন্তু মোমিকা শুধু কোরআন পুড়তে গেলেন কেন? সালওয়ান মোমিকা নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করলেও তিনি নাস্তিক নন। কারণ কোন নাস্তিক ধর্মের সঙ্গে সরাসরি শারীরিক যুদ্ধে লিপ্ত হয় না।
হুমায়ূন আজাদের ভাষ্য অনুযায়ী ধার্মিকরাই ধর্মের অবমাননা করে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ইত্যাদি উপসনালয় ভেঙেছে ধার্মিকরা, উপসনালয়ে বোমা মেরে এক ধার্মিককে হত্যা করে ভিন্ন মতের আরেক ধার্মিক। পাকিস্তানে হরহামেশা যারা মাজার, মসজিদে বোমা মেরে মুসল্লিদের হত্যা করছে তারা নাস্তিক নয়- তারা তালেবান, দায়েশ, লশকরে জাঙ্গাভি ও সিপাহে সাহাবার মতো উগ্র ধর্মীয়গোষ্ঠী। পাকিস্তানে শিয়া, আহমদিয়া, খ্রিস্টান, হিন্দু, শিখ ইত্যাদি তরিকা ও ধর্মের ধার্মিকদের ওপর যেসব সশস্ত্র হামলা হয়েছে তার অধিকাংশ হয়েছে সুন্নি সম্প্রদায়ের মৌলবাদী গোষ্ঠীর তরফ থেকে। আফগানিস্তানে তালেবান শাসনে শরিয়া আইন প্রবর্তন করা সত্ত্বেও অপর কট্টর ধর্মীয়গোষ্ঠী আইএস এবং আল কায়েদার বোমা হামলা থামেনি, তারা বোমা মেরে তালেবান মুসলিমদের হত্যা করছে। ভারতে বাবড়ি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়েছে কোন নাস্তিক নয়, উগ্র হিন্দুধর্মীয় গোষ্ঠী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস, বজরং, শিব সেনারা; এরা ধর্মনিরপেক্ষতা বা নাস্তিকতায় বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে রামরাজ্যে, হিন্দু জাতীয়তাবাদে। বাংলাদেশে যারা পুজামন্ডপ ভাঙে তাদের একজনও নাস্তিক নয়, এরা অতি ধার্মিক। কোন নাস্তিক ধর্মের বিরুদ্ধে জিহাদ করে না, ধর্মগ্রন্থ ধ্বংস করে না, কারণ কোন ধর্মই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই একটি ধর্মগ্রন্থকে পুড়িয়ে আরেকটি ধর্মগ্রন্থকে প্রতিষ্ঠিত করার কোন অভিলাষ তাদের নেই।
পৃথিবীতে দেড়শ থেকে দুইশ কোটি লোক সংশয়বাদী বা নাস্তিক। নাস্তিকদের জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা দুটোই থাকে, জ্ঞান এবং প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ বলেই তারা যুক্তিবাদী; তারা মারামারি করে না, কাটাকাটি করে না, তারা শুধু রুচিশীল ভাষায় যুক্তি দিয়ে নিজের কথাগুলো বলে যায়, কেউ না শুনলেও তাদের কোন আক্ষেপ থাকে না। সালওয়ান মোমিকার জ্ঞানও নেই, প্রজ্ঞাও নেই। জ্ঞানকে অন্তরে কর্ষিত না করলে তা প্রজ্ঞায় উন্নীত হয় না। তাই পুঁথিগত বিদ্যা প্রজ্ঞা নয়। চোর, বাটপার, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজও জ্ঞানী হতে পারে, কিন্তু তারা চিন্তায় সৎ নয়, তাদের জ্ঞান কর্ষিত ও চর্চিত নয় বিধায় তা ধ্বংস আর অকল্যাণে ব্যয়িত হয়। এমন জ্ঞানী লোকগুলো কুটিল, ধুরন্ধর এবং বিপজ্জনক। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির অন্তদৃষ্টি এবং দূরদৃষ্টি দুটোই থাকে, তারা নির্বোধের মতো কাজ করে না। শুধু প্রজ্ঞাই মানুষকে ইতর জীব থেকে পার্থক্য করতে পারে। মোমিকা নিজেকে নাস্তিক পরিচয় দিয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে অপমানিত করেছে। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি সব সময় সংযত আচরণ করে থাকেন। সক্রেটিসের জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা দুটোই ছিল, কিন্তু অকাট্য যুক্তি দিয়ে তিনি মানবজীবনের সবাই আবেগ-অনুভূতি এবং চারপাশের জগতকে বদলাতে পারেননি। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী, সম্প্রীতি নষ্ট করে এমন কোন জঘন্য কাজ কোন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি করতে পারেন না।
পশ্চিমা বিশ্বের দেশ সুইডেন বাক স্বাধীনতার নামে এখন কোরআন পুড়ছে, অথচ পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মীয় পুরোহিতারাই এক সময় ধর্ম অবমাননার নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে, মুক্তবুদ্ধির কথা বন্ধ করতে জিহ্বা কেটে দিয়েছে। আরও বিস্ময়কর খবর হলো, পশ্চিমা বিশ্বই সর্বপ্রথম ব্লাসফেমি আইন পাস করে নবি আর সৃষ্টিকর্তা বিরোধী উক্তির বিচার করেছে। ধর্মের বিরুদ্ধে জিহাদে নামলে ধর্মের ক্ষতি হয় না, বরং ধার্মিকরা জোটবদ্ধ হয়ে কট্টরপন্থার চর্চা করে।
ফ্রান্সের ক্লাসে কোনো মুসলিম ছাত্র বা ছাত্রী যখন শিক্ষকের শিরচ্ছেদ দেখে সন্ত্রাসী হামলার সমর্থনে উল্লাস করে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ধর্মীয় অনুভূতি জিহাদি আচরণ দিয়ে দূর করা যায় না, জিহাদি আচরণে তা দ্বিগুণ বেগে জাগ্রত হয়। ধর্ম এবং রাজনীতির সমঝোতামূলক দাবা খেলায় এক পক্ষ হচ্ছে ধার্মিক এবং আরেক পক্ষ হচ্ছে রাজনীতিবিদ। এরা আত্মঘাতি, নিজেও মরে, অন্যকেও মারে। মোমিকার হঠকারি অপকর্মের জন্য শাস্তি হওয়া উচিত।
[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল]