Skip to content

দক্ষিণ চট্টগ্রামের লক্ষাধিক মানুষের ঈদ উদযাপন

দক্ষিণ চট্টগ্রামের লক্ষাধিক মানুষের ঈদ উদযাপন

জাফর ভাইকে ডায়ালাইসিস নিতে হবে, এটা আমি কখনো ভাবিনি। কিন্তু তিনি নির্বিকার। কোনো কাজের কথা থাকলে ফোন দিলেই চলে যেতাম। কাজের গতিতে কোনো খামতি নেই। যখন অসুস্থতা তাকে কাবু করে ফেলছে, তারপরও টেলিভিশন টকশোতে হাজির থাকতেন। ডায়ালাইসিস নিতে নিতে নিজের বেডে বসে কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে হুইলচেয়ারে বসে ছুটে গিয়েছেন। মৃত্যুর আগে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বিছানায় জোর করে তাকে ধরে বেঁধে রাখতে হয়েছে। একদমই অসুস্থ হয়ে পড়ার পর একদিন তাকে দেখে মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে যাই। ঠিক করেছিলাম আর যাব না। এই শীর্ণকায় অসুস্থ জাফর ভাইকে আমি চিনি না। মৃত্যুর দুদিন আগে ফরিদা আখতার আর আমি আবার গিয়েছিলাম। বসতে চেয়েছিলেন, ধরে ডাক্তার-নার্সদের চেষ্টায় বসানো হলো কিছুক্ষণ। একটু পানি খেতে চেয়েছিলেন সে সময়। তাকে বসা অবস্থায় এই শেষ দেখা। এরপর সেই অমোঘ রাত্রি এলো। সাদা পোশাকে যখন তিনি শেষবারের মতো যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন, তখন আরেকবার দেখলাম।

বলা বাহুল্য, তার প্রিয় মানুষদের কাছে তিনি নানানভাবে স্মৃতি হয়ে থাকবেন, নানানরূপে নানান অর্থ নিয়ে স্মৃতি আমাদের বারবার তাড়া করবে। বন্ধুদের মধ্যে গল্পে গল্পে ফিরে আসবেন। তবে সত্য এই যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটা কালপর্ব শেষ হলো। এখন মূল্যায়নও করতে হবে আমাদের সেই ইতিহাসের গোড়া থেকে। দেশের মানুষ তাকে গভীর ভালোবাসা থেকে যে সম্মান দিয়েছে সেটা তার প্রাপ্য। আমাদের এখন যে কাজটা করতে হবে সেটা হলো বাংলাদেশের আগামী ইতিহাসের ক্ষেত্রে জাফর ভাইয়ের তাৎপর্য কী হতে পারে সেই পর্যালোচনা আস্তে আস্তে তরুণদের কাছে তুলে ধরা। জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে জীবনযাপন করে গেলেন তার তাৎপর্য নিজেরা বোঝা এবং তার সারকথাগুলো কী হতে পারে ভেবে দেখা। কীভাবে সহজভাবে আমরা সেটা আগামীর দূরদর্শী তরুণদের কাছে তুলে ধরতে পারি সেটা নিজেদের কাছে পরিচ্ছন্ন করে তোলা। সর্বোপরি সাধারণ মানুষদের কাছে সহজ ভাষায় সহজ কথায় আমাদের কর্তব্য যেন তুলে ধরতে পারি সেই চেষ্টা করা।

কীভাবে সেটা করব? জাফরুল্লাহ চৌধুরী একই শার্ট ত্রিশ বছর ধরে পরেছেন। এটা কী বলব? হ্যাঁ বলব, এটা মিথ্যা না, কিন্তু তিনি নতুন জামাও পরেছেন। তিনি সাধারণত হাফ হাতার হাওয়াই শার্ট পরতে পছন্দ করতেন। সম্ভবত ছাত্রাবস্থা থেকেই এক ধরনের বেপরোয়া মাস্তানি ভাব ফুটিয়ে রাখতে আনন্দ পেতেন। একটা বুটিক প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট অনেক দিন ধরে পরেছেন। এসব মেলা গল্প বলাই যায়। আর তার ছেঁড়া প্যান্টের গল্প তো আছেই। তার ছেঁড়া স্যান্ডেলও আমরা দেখেছি। ক্ষয় হয়ে গেছে কিন্তু তিনি সেটা পরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুরুতেই এটা বুঝতে হবে, এহ বাহ্য! এগুলো বাইরের ব্যাপার।

বাইরের গাল-গল্প বাদ দিলে মোদ্দা কথা, কোথা থেকে শুরু হতে পারে? সেটা নানান দিক থেকেই হতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা এবং তর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন থেকে আমরা শুরু করতে পারি সেটা হলো জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে বুঝেছেন? এটা খুবই ভালো যে, তার সম্পর্কে কথা উঠলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধকে তার জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিংবা তাকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বোঝা প্রাসঙ্গিক হয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামক কথাটিকে যেভাবে দলীয় রাজনৈতিক চিন্তার হাতিয়ার বানানো হয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সূত্র হিসেবে তিনি আগামী দিনে তরুণদের কাছে পরিচ্ছন্ন প্রতীক হয়ে উঠবেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রাম বললে তরুণরা জাফরুল্লাহকে বুঝুক তিনি নিজের কাজের মধ্য দিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।

সমর নীতি ও কৌশলের দিক থেকে তিনি বাস্তবের রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে বুঝেছেন? সেসব খুঁটিনাটির জায়গা থেকেও আমরা আলোচনা করতে পারি। বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধ একটি সামরিক ব্যাপার। এই সামরিক দিকটা তিনি কি সেনা অফিসারদের মতো বুঝেছেন, নাকি তার বোঝাবুঝির ক্ষেত্র ভিন্ন ছিল। এ বিষয়ে তার কাছ থেকে শুনে এবং রণক্ষেত্রের ঘটনাবলি সম্পর্কে অন্যদের লেখালিখি ও গল্প থেকে যা বুঝেছি তার একটা দূরদর্শী অবস্থান ছিল। সামরিকতার দিক থেকেও মুক্তিযুদ্ধকে তিনি শুরু থেকেই গভীরভাবে বুঝেছেন। কীভাবে আমরা তা জানি? ছোট উদাহরণেই বুঝি। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের জন্য অবশ্যই ফিল্ড হাসপাতাল আর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা যুদ্ধের নীতি ও কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ এটা তিনি বুঝেছিলেন শুরু থেকেই। তিনি পাক্কা বুঝেছিলেন। এটা নিজে বোঝা এবং অপরকে বোঝানো খুব সহজ ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ফিল্ড হাসপাতালের মাধ্যমে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদানের জন্য বিলাত থেকে চলে আসেন। মেলাঘরে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যখন তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, আমাদের ডাক্তারের প্রয়োজন নেই, গেরিলা প্রশিক্ষণ নিন এবং অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিন। এই গল্প আমি জাফর ভাইয়ের মুখে অনেকবার শুনেছি। তারা ট্রেইন্ড সার্জন বুঝিয়ে বলার পরও তৎক্ষণাৎ বোঝানো যায়নি। এখানে খালেদ মোশাররফকে ভিন্ন ভাবার কোনো কারণ নেই। এই অসম সাহসী সৈনিকের অবদান আমাদের মনে রাখতে হবে। রাজনৈতিক ডামাডোলে এদের আমরা অবমূল্যায়ন করি। এই গল্প বলার উদ্দেশ্য খালেদ মোশাররফকে সমালোচনার জন্য না। জাফরুল্লাহকে বোঝার জন্য। তিনি শুরুতে খালেদ মোশাররফকে বোঝাতে পারেননি। এটাও সত্য কথা যে, যুদ্ধে যখন আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকল তখন খালেদ মোশাররফ নিজেই ফিল্ড হাসপাতালের গুরুত্ব বুঝলেন। বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে উঠল।

জাফর ভাই সম্পর্কে একালের তরুণদের যে দিকটা শেখার সেটা হলো, যুদ্ধ নিছকই গোলাবারুদ বন্দুক কামান না। এর নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক আছে। মুক্তিযুদ্ধ সমাজ বিচ্ছিন্ন সামরিকতা বা সৈনিকতা না। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি ফিল্ড হাসপাতাল থাকার মানে মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক বলকে দৃঢ় করা, যার অভাব যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জয়-পরাজয়ে তার ভূমিকা থাকে। সমরনীতি ও কৌশলের দিক থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিনের এই দূরদর্শিতা আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন বাংলাদেশের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। ফলে জাফর ভাইয়ের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাগুলোর প্রতি আমাদের আজ হোক কাল হোক আরও নিবিড়ভাবে মনোযোগ দিতে হবে।

কিন্তু জাফর ভাই মুক্তিযুদ্ধকে আরেকটি তাৎপর্য দিয়েছেন বা আরেকটি স্তরে উন্নীত করেছেন। যা বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে যুদ্ধ। সেটা হলো গরিব, বঞ্চিত হতদরিদ্র ও লাঞ্ছিতদের জন্য স্বাস্থ্য, খাদ্য, পুষ্টি, আবাস, বস্ত্র ইত্যাদি আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়াই মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ তার মুক্তিযুদ্ধ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেষ হয়নি। বিশ্রামগঞ্জের ফিল্ড হাসপাতালের ধারাবাহিকতা পুরো দমে চলছে। বিশ্রামগঞ্জের ফিল্ড হাসপাতাল বাংলাদেশের সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে গড়ে উঠল। বাকিটা ইতিহাস। এখন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কী করা যেতে পারে সেটা আমরা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজ থেকে বুঝি, কাজের সাফল্য থেকে নিশ্চিত হই মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে গণমানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার আন্দোলনে পরিণত করতে হয়। কেন সেটা জরুরি। রণক্ষেত্র পাল্টিয়ে গিয়েছে। যারা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের লড়াইয়ে নেই তারা মুক্তিযুদ্ধেও নেই। ঠিক। জাফর ভাই বুঝতেন মুক্তিযুদ্ধকে রূপ দিতে হবে বীজ ও খাদ্যের সার্বভৌমত্ব অর্জনের লড়াই হিসেবে। মেয়েদের অধিকার হিসেবে। লিঙ্গভিত্তিক যে শ্রমবিভাগ গড়ে উঠেছে তাকে ভেঙে দিতে হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষার লড়াই একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা। কারণ জনগণকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। হেলমেট মাথায় হাতুড়ি লীগ হওয়াকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে না। মুক্তিযুদ্ধ কোনো অতীতের ব্যাপার নয়। যুদ্ধ চলছে। চলবে।

দ্বিতীয়ত, জাফর ভাই সবসময় বুঝিয়েছেন কোনো যুদ্ধই একা করা যায় না। ফলে বাংলাদেশে তার একটা সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের লড়াই তাদের কাজের নানান ক্ষেত্রে চালিয়ে গিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা জাফর ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে যার কথা না বললেই নয় তিনি হচ্ছেন শাহাদাত চৌধুরী, সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক। শাচৌ নামে বিখ্যাত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান নিয়ে যদি কথা হয় তাহলে শাহাদাত চৌধুরীর কথা উঠবেই। তিনি জাফর ভাইকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করেছিলেন এবং তার মাধ্যমে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে মানুষ ভিন্নভাবে চিনেছিল। শুধু সে জন্য নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমানের উত্থানসহ বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ে শাহাদাতের অবদান ভোলার নয়। শাহাদাত চৌধুরীও আজ বেঁচে নেই। জাফর ভাইকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তার কথা বলে রাখা জরুরি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জাফর ভাইয়ের চিন্তায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই না, মুক্তিযুদ্ধ মানে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে জাতীয় স্বার্থরক্ষার লড়াই। তাই তিনি যখন গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠা করলেন তখন তার বিজ্ঞাপন দিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি’। আসলেই সাধারণ মানুষের জন্য কম দামে জরুরি ওষুধ উৎপাদন করা মুনাফাখোর বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে, শুরুতে তার এই কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত হতে পেরেছিলাম। আমি পেশায় ফার্মাসিস্ট বলে তিনিই আমাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ধরে এনেছিলেন। তিনি ওষুধ বানানোর জন্য পেশাদার মানুষ যেমন এনেছিলেন তেমনি গ্রামের অল্প লেখাপড়া জানা মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ওষুধ তৈরি করা শিখিয়েছিলেন। এদের অনেককে লন্ডন, ফ্রান্সে পাঠিয়ে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। তাকে সবাই বড় ভাই ডাকতেন। এর মধ্যে সম্মান ছিল আর ছিল অগাধ ভালোবাসা। বদরাগী ছিলেন। তার সামনে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না ‘এই কাজ আমি কি করতে পারব?’ জাফর ভাইয়ের রাগ সপ্তমে চড়ত। মানুষ পারে না এটা কীভাবে সম্ভব? পারার জন্য যা দরকার তা সরবরাহ করতে কুণ্ঠা ছিল না। কর্মীরা পেরেছে। জাফর ভাইয়ের অগাধ বিশ্বাস ছিল তার কর্মীদের ওপর।

তার কাছে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার হাতিয়ার। কারণ আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান অর্জন অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই থেকে ভিন্ন কিছু না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মানে হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরানো না। বাংলাদেশের দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে উঠতে পেরেছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জাতীয় ওষুধনীতির জন্য। জাতীয় ওষুধনীতি গড়ে উঠত না যদি গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠা করা না যেত। একদিকে বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশকে স্রেফ তাদের পণ্যের বাজার বানাবে, আমাদের কোনো শক্তিশালী উৎপাদন ক্ষেত্র গড়ে উঠবে না, আমাদের টেকনোলজি ট্রান্সফার হবে না, তদুপরি তারা ওষুধের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি রেখে মুনাফা কামাবে, জরুরি ওষুধ মানুষের কাছে সহজলভ্য করার কোনো চেষ্টা করবে না তা তো হবে না। একই ওষুধ বিভিন্ন দামে বিভিন্ন কোম্পানি বিক্রি করে যাচ্ছে, সেটাই বা কেন? সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়া মানে এই অসাম্যের অবসান ঘটানো। অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলোও ওষুধ উৎপাদনে নিয়মনীতি মানছে না। গুণগতমান বজায় রাখছে না। সেটা কেন হবে? মুক্তিযুদ্ধকে তিনি নিয়ে এলেন এই শোষণ ও অন্যায় উৎপাটনের লড়াই হিসেবে। জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তার সংকল্প প্রমাণ করে ছাড়লেন।

নয়াকৃষি আন্দোলন নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। কৃষিকে তিনি কিংবা আমি দুজনের কেউই স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার সংগ্রাম থেকে আলাদা ভাবিনি। দেশীয় বীজ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে তার প্রবল উৎসাহ ছিল। খোঁজখবর রাখতেন সবসময়ই। একালে লর্ড ক্লাইভের দরকার হয় না। জমি দখল হয়ে যাওয়ার যে ফল, তার চেয়ে অধিক ভয়ংকর দেশীয় বীজ হারানো। সাম্রাজ্যবাদের রণক্ষেত্র তিনটি পানি, বীজ ও জ্বালানি।

আজ বেশি মনে পড়ছে তার মুখের ‘ফরহাদ’ ডাক। খুবই কানে ভাসছে। ওই কণ্ঠস্বর আমি আর শুনব না ভেবে কাতর হয়ে পড়ি। সেই ডাকে গভীর বন্ধুত্বের বন্ধন যেমন, তেমনি ছিল অফুরন্ত স্নেহ। অস্থির হয়ে বলতেন, আপনি লেখেন, আরও লেখেন। আপনি তো বিশ্লেষণ করতে পারেন। আরও লেখেন।

লিখব জাফর ভাই। আপনার জন্যই লিখব।

লেখক: কবি, দার্শনিক

[email protected]



বার্তা সূত্র