আলম রায়হান
আলম রায়হান: বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের বক্তব্যে দেশব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ বক্তব্যকে অসত্য বলে তা প্রত্যাখ্যান করে ১৯২ জন বাংলাদেশি বংশদ্ভূত মার্কিন নাগরিক যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ওই কংগ্রেসম্যানরা দাবি করেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।’
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশ ঘিরে ভয়াবহ অপপ্রচার চলে লাগাতরভাবে। এর সঙ্গে পো ধরার লোকের সংখ্যা দেশের অভ্যন্তরেও কম নেই। আছে অন্যান্য দেশেও। কিছু দিন পরপরই জোরে আওয়াজ তোলা হয়, ‘বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালাচ্ছে।’ নানা প্রযুক্তিগত কৌশল ব্যবহার করে এমন মনগড়া, রোমহর্ষক কাহিনীর ভিডিও চিত্র প্রচারিত হয়। অপপ্রচার করা হয়, বাংলাদেশের মুসলমান হিন্দুদের মন্দির অপবিত্র করছে। হিন্দু বিগ্রহকে অপমান করছে- এমন ধরনের নানা রকমের ছবি। যা জালপরা বাসন্তির ছবিকেও হার মানায়।
বাসন্তির ছবিকে ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর সরকাররে ভিত কাঁপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এখন চলছে খোদ বাংলাদেশের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। ভারতের সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক হিন্দুরা নিজেদের রাজনৈতিক ভিত মজবুত করার জন্য সামাজিক গণমাধ্যমকে ভয়াবহভাবে ব্যবহার করছেন। যার কিঞ্চিত প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় ছয় মার্কিন কংগেগ্রেসম্যানের বক্তব্যে। সংক্ষেপে বলা হয়, এ বক্তব্য হচ্ছে ৪৭ পূর্ববর্তী পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা।
মার্কিনী কাণ্ড এই প্রথম বা একমাত্র নয়। এ ধরনের কাণ্ড ঘটেছে ২০২২ সালেও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ২০২২ সালের ২ জুন প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও জাতিগত সংখ্যালঘু সদস্যদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ কিংবা জমি দখল রোধে সরকার পদক্ষেপ নিলেও সুফল আসেনি। আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক দুই হাজারের বেশি পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ১৬ পৃষ্ঠার একটি পর্যালোচনা রয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ২০২১ সাল জুড়ে হামলা হয়েছে। এবং যুক্তরাষ্ট্র এই মূল্যায়ন করেছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘তথ্য’ উদ্ধৃত করে।
সেই সময় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত বলেছেন, ‘সংখ্যালঘুরা ভালো নেই। তাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ তৃণমূলে ছড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি এমনকি সমাজের সর্বস্তরে সাম্প্রদায়িকতা আজ বাসা বেঁধেছে। বাঙালি আর বাঙালি থাকছে না। এই বাস্তবতায় সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, তা প্রতিরোধে না আছে প্রশাসন; না আছে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিরোধ। যখন মামলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ধরা পড়ে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তারা বেরিয়ে আসছে। তাদের কোনো বিচার হয় না।’
দেশের ভিতরে এবং বাইরে এইধরনের মতলবী বয়ান চলছেই। এদিকে ভয়ানক এইসব অভিযোগকে ‘হাঁসের পালকে পানি’ বিবেচনা করে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এবার ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের বক্তব্যের পর চায়ের কাপে ঝড় তোলার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এক পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি বিএনপি-জামায়াত প্রভাবিত লবিস্টদের কাজ। যেনো, এখানেই শুরু এবং এখানেই পরিণতি। কিন্তু বিষয়টি অতটা সরল অংক মনে করার কোন কারণ নেই। গভীরভাবে বিচেনায় নিলে পরিস্কার হবে, ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের বক্তব্যে কেবল সরকার বিরোধী লবিস্টদের কান্ড হিসেবে বিবেচনা করলে বিষয়টি অন্ধের হাতি দেখার মতো হবে। এর শিকড় অনেক গভীরে। যার সূচনা হয়েছে ভারত বিভক্তির আগেই।
আলম রায়হান: সিনিয়র সাংবাদিক