নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রাম আয়তনে বাংলাদেশের এক-দশমাংশ। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানকে বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই অঞ্চলে বসবাস করে বাঙালিসহ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী। পর্যটনশিল্পে অপার সম্ভাবনাময় এ অঞ্চলে রয়েছে প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ। কাছাকাছি বিশ্বখ্যাত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, নৈসর্গিক ভৌগোলিক অবস্থান, ল্যান্ড লক ভারতের সেভেন সিস্টার, কৌশলগত ট্রানজিট ও নানান কারণেই এ অঞ্চলের ওপর রয়েছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর নজর।
চাকমা উপজাতির সশস্ত্র বিদ্রোহী আন্দোলনের ইতিহাস :ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। সেই সময় চাকমা জাতি ১০ বছরব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলনে লিপ্ত ছিল। ব্রিটিশ রাজ্যের একটি স্বশাসিত এলাকারূপে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বীকৃতি লাভ ছিল ঐ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। এর ফলে ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অধ্যাদেশ ঘোষিত হয়।
বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়। তখন রাজমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে ১৯১৫ সালে প্রথম চাকমা যুবক সমিতি গঠিত হয়। ১৯১৯ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ানের নেতৃত্বে গঠিত হয় চাকমা যুবক সংঘ। ১৯২০ সালে কামিনী মোহন দেওয়ান গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি। প্রায় দুই দশক ধরে এই সংগঠনটি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৩৯ সালে যামিনী রঞ্জন দেওয়ান ও স্নেহকুমার চাকমা এই সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। তখন থেকেই জনসমিতির মূল রাজনৈতিক তত্পরতা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে জনসমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা করে।
পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম পড়ল পাকিস্তান অংশে। তখন স্নেহকুমার চাকমার গ্রুপ সেটা মানতে অস্বীকার করে সেখানে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে রাখে। তিন দিন পর নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করে। সেখান থেকেই পাহাড়িদের মনে একধরনের অবিশ্বাসের সূত্রপাত ঘটে, নিরাপত্তা বাহিনীকে দেখা হয় নেতিবাচক দৃষ্টিতে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে পাহাড়ি ছাত্রদের দাবি আদায়সংক্রান্ত একটি সংগঠন হিল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা ও জে বি লারমা। এ সমিতির সমর্থনে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
কুকি-চিনদের সশস্ত্র বিদ্রোহী আন্দোলনের ইতিহাস :কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নিজেদের অনগ্রসর ও অবহেলিত সম্প্রদায় দাবি করে আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অশান্ত করে চলেছে। ফলে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের কথা বিবেচনা করে পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী কেএনএফকে দমনের জন্য সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে।
এদিকে সেনাবাহিনীর পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দমনের এই অভিযানকে বিতর্কিত করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর পূর্ব ইতিহাস পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকিরা চিন, তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া থেকে আগমন করে মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে। প্রবাদ আছে, কুকিরা মোঙ্গোলিয় মহাজাতির একটি শাখা। কুকি মূলত কোনো একক নৃগোষ্ঠী নয়। প্রায় ৫০টি জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে কুকি-চিন-মিজো জাতি গঠিত। তাদের অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠী মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বসবাস করে, তাদের বড় একটি নৃগোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম রাজ্যে মিজো জাতি, যারা বাংলাদেশে বম, লুসাই ও পাংখোয়া নামে পরিচিত। এই জাতিগোষ্ঠীর একটি অংশ মিয়ানমার ও ভারতে থাডো নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের চেয়ে ভারতের মিজোরাম জেলায় কুকি জো জাতির বসবাস বেশি। বাংলাদেশের বান্দরবান সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল অঞ্চলে তাদের বেশি বসবাস রয়েছে। এসব জাতিসত্তা নিজেদের বলে ‘জো’।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার পাহাড়ি এলাকায় অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কুকিরা স্থানীয় সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু করে। কুকিদের এই আক্রমণে ১৮৬ জন ব্রিটিশ প্রজা খুন হয় এবং আটক হয় ১০০-এর অধিক। এছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপরও অত্যাচার করতে থাকে কুকিরা। প্রশাসনিকভাবে এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কুকিদের শায়েস্তা করার জন্য ব্রিটিশরা নানান আইন প্রণয়ন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মূল বিরোধ হচ্ছে চাকমাদের সঙ্গে। খ্রিষ্টীয় ১৬০০ শতকের দিকে আগত কুকিরা পরবর্তী অনুপ্রবেশ করা চাকমা কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রিটিশরা চাকমাদের সহযোগিতায় কুকিদের দেশান্তরিত করেছিল। তার দায়ভার তো স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী বহন করতে পারে না; তার জন্য কুকিরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে পারে না।
১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে উপজাতিদের অবস্থান :মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দেশদ্রোহীদের মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন রাজা ত্রিদিব রায়। তবে উপজাতীয় যুবকদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অধিকাংশই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত ‘সিভিল আমর্ড ফোর্স’ বা ‘সিএএফ’ (রাজাকার বাহিনী হিসেবে পরিচিত)-এ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তত্পরতায় অংশ নেয়। তত্কালীন রাজাকার বাহিনীতে তুলনামূলকভাবে চাকমাদের সংখ্যাই ছিল বেশি।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়, ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য নেতৃত্ব পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান করলেও বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংগ্রামের সময় ঐ নেতৃত্বই আবার পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। রাজার নির্দেশে হেডম্যান, কার্বারিরা তখন গ্রামের লোকদের জোরপূর্বক রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করে। অনেকেই বেতন এবং অস্ত্রের লোভে ‘সিএএফ’-এ যোগ দেয়। চাকমা ও অন্যান্য উপজাতিদের গুপ্তচরবৃত্তির কারণে স্বাধীন বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারেননি। যার অংশ হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ নানিয়ার চরের বুড়িঘাটে শাহাদাত বরণ করেন। কুকি, বম, খেয়াং, লুসাই, খুমি, তংচোংগাসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র উপজাতিগুলো এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনে বিরোধিতা করে আসছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেলের তিন রাজার মধ্যে একমাত্র মানিকছড়ির রাজা মংপ্রু চাঁই চৌধুরী (বা মংপ্রু সাইন) মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আর বোমাং সার্কেলের রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নীতিগতভাবে বাংলাদেশ বিদ্বেষী ছিলেন না।
এদিকে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি জেএসএস-এর সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী গঠিত হয়। এই শান্তিবাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকে উপজাতি সন্ত্রাসীরা বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় মেতে ওঠে। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের হামলায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নিহত হন। এরপর তার ছোট ভাই জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের পাঁয়তারা চলছে।
স্বাধীন জুম্মল্যান্ড গঠনের হাতিয়ার হিসেবে সম্প্রতি উপজাতিরা নিজেদের আদিবাসী দাবি করা শুরু করেছে। কারণ আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। যদিও আমরা জানি, বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, বরং মূল বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিপরীতে এই অবাঙালি জনসমষ্টিকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী নামে অভিহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থানের ফলে আদিবাসী ইস্যু কিছুটা স্তিমিত হলেও বাংলাদেশের তথাকথিত একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীকে হাত করে এ ব্যাপারে তাদের অপতত্পরতা অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলেও অপতত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া এবং চোরাগোপ্তা হামলা করা কুকিদের উগ্রবাদী মনোভাবের প্রকাশ পায়। কুকিরা এই রাষ্ট্র কর্তৃক কখনো দেশান্তরিত বা নির্যাতিত হয়নি। কুকিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বারবার ছাড়তে হয়েছে চাকমাদের কারণে। কুকিদের এই যুদ্ধ হওয়া উচিত চাকমাদের বিরুদ্ধে। তারা তা না করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিজোরাম অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আইজল থেকে এ দেশে বসবাসরত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রবল সমর্থন দেখা যাচ্ছে। এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ বিরোধী নানান কুত্সা ও প্রোপাগান্ডা দেখা যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ কুকি-চিন জনগোষ্ঠী কেএনএফের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনকে সমর্থন করে না এবং কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না কেএনএফ, তা সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্ট জানিয়েছে ছয়টি জো জাতির প্রতিনিধিগণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা ও কুকি-চিনের এই সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য কতিপয় উপজাতীয় নেতা এবং কিছু বামপন্থি সন্ত্রাসী মহল দায়ী। সাধারণ পাহাড়িরা এখন বুঝে গেছে, উগ্রবাদী এসব উপজাতীয় নেতারা আসলে তাদের জিম্মি করে রাখতে চায়। চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যাদের মূল লক্ষ্য। অনেকেই এখন এই সন্ত্রাসী মহলের তাণ্ডবলীলা থেকে বেরিয়ে এসে শান্তি সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছেন। তবে তারা কোনো সন্ত্রাসী দলকে অন্তরে জায়গা না দিলেও মুখ খুলে তাদের বিরুদ্ধে জনসম্মুখে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না।