Skip to content

চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ

চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ

পাঁচটি উঁচু ভবনসহ সাতটিতে প্রায় দেড়শ আদালতের এজলাস। স্বল্পায়তন কিন্তু জনবহুল এলাকার চারপাশে একটির সঙ্গে আরেকটি ঘেঁষে অন্তত ৫০টি ছোট-বড় ভবন। মূল সড়কঘেঁষে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়সহ বেশ কিছু সরকারি দপ্তর। সড়কের ওপাশে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সিনেমা হল। অদূরে বাহাদুর শাহ পার্ক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সদরঘাট।

পাশেই শাঁখারীবাজার, রাজারদেউড়ি, তাঁতীবাজার, পাটুয়াটুলী, রায়সাহেব বাজার, ইংলিশ রোড, লক্ষ্মীবাজারের মতো অতি ব্যস্ত এলাকা। অসহনীয় যানজট, অগ্নিকাণ্ড, আসামি ছিনতাইসহ নানা দুর্ঘটনা ও অপ্রীতিকর ঘটনা নিত্য ঘটে। প্রচণ্ড ভিড়ে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, আসামি বা পুলিশকে হাঁটতে হয় গায়ে গা-ঘেঁষে। পুরান ঢাকার জনসন রোডে আদালতপাড়ার নিত্যচিত্র এ রকমই।

আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের ভাষ্য, সার্বিক চিত্র আদালতের পরিবেশের সঙ্গে বেমানান। এই এলাকায় আদালতের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান নিয়ে অস্বস্তি রয়েছে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের।

ব্রিটিশ আমলে এ এলাকায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হয় প্রায় ১৩৫ বছর আগে। তখন জনসংখ্যা ও মামলা অনুপাতে ছোট পরিসরে বিচারকাজ হলেও এখন সবকিছুর পরিধি বেড়েছে। ১৩৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বারে আড়াই দশক আগেও তালিকাভুক্ত আইনজীবী ছিলেন চার হাজার। এখন আইনজীবী প্রায় ২৮ হাজার। মামলাও বেড়েছে। ভবন ও এজলাস বেড়েছে। বিচারপ্রার্থীসহ আদালত-সংশ্লিষ্ট মানুষও বেড়েছে। কিন্তু আদালতের পরিসর আরও ছোট হয়েছে। পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তীব্র গরমে ভয়াবহ অবস্থা হয়।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গত কয়েক দিনে অন্তত ২৫ জন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বিচারপ্রত্যাশী, সাক্ষী ও এলাকাবাসীর সঙ্গেও। তাদের বেশিরভাগ বলেছেন, এখানে আদালতের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। আদালত স্থানান্তর কিংবা আদালতের বিকেন্দ্রীকরণও যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ও কঠিন কাজ। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, ঢাকা বারের সাবেক ও বর্তমান কমিটির নেতাদের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ বছরে এখান থেকে আদালত স্থানান্তরের একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে তা সফল হয়নি। কাছেই সুপ্রিম কোর্ট। পেশাগত সুবিধা বিবেচনায় আপত্তি রয়েছে আইনজীবী অনেকের।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগ, ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ছয়তলা ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত, ৯-তলা ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালত (নতুন) ভবন, ছয়তলা ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালত (পুরনো), ১০-তলা সিজেএম (চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) আদালত, ১০-তলা সিএমএম (চিফ মেট্রোপলিটান) আদালত, তিনতলা রেবতী ম্যানশনসহ ছয়টি এবং আরও কিছু ভবনে বিচারকাজের এজলাস রয়েছে ১৪৪টি।

এসবের ৯১টিতে ফৌজদারি মামলার বিচার পরিচালিত হয়। বাকিগুলো দেওয়ানি ও অন্যান্য আদালতের এজলাস। সব এজলাসের পাশে রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক অফিস বা সেরেস্তা। বেশিরভাগ এজলাস ছোট পরিসরের। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে। আইনজীবীরা বলেন, এখানে বিচারপ্রার্থীদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মানসিক প্রশান্তি নেই। আদালত এলাকাটি হয়ে উঠেছে বাজারের মতো। ঝগড়া, বাগ্বিতণ্ডা, মারামারি, চুরি ও ছিনতাই নিত্য ঘটনা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শাঁখারীবাজারে ঢোকার গলির মুখ থেকে কোর্ট হাউজ স্ট্রিট পর্যন্ত সরু সড়কে অন্তত ৩২টি ছোট-বড় ভবন। প্রায় সবগুলোই আইনজীবীদের চেম্বার। এর মধ্যেই ঢাকা বারের ১০-তলা ভবন রয়েছে। এই সড়কসহ পুরো আদালত এলাকার দুপাশে কয়েকশ ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী দোকান।

কর্মদিবসে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের আনাগোনা

মামলা ও আইনজীবীর সংখ্যার বিচারে এটি এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বার হিসেবে পরিচিত। কেউ এটিকে বিশে^র সবচেয়ে বড় বারও মনে করেন। ঢাকার আদালতগুলোতে কত মামলা বিচারাধীন তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও সংখ্যাটি পাঁচ লাখের কাছাকাছি।

এখানে নিয়মিত মামলায় শুনানি করেন ১২ থেকে ১৩ হাজার আইনজীবী। বিচারক প্রায় দেড়শ। প্রতিদিন থানা ও কারাগার থেকে ৬০০ থেকে ৭০০ আসামিকে আনা-নেওয়া করা হয়। একই সঙ্গে বিচারাধীন মামলার আসামি থাকেন কয়েক হাজার। রয়েছেন আদালত-সংশ্লিষ্ট নথি বিক্রেতা এবং খাবার, শাকসবজি ও কয়েকশ স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ দোকানের ব্যবসায়ীরা।

ঢাকা বারের আইনজীবী নেতারা বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের বাইরে প্রতি কর্মদিবসে আদালত এলাকায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। মানুষের ভিড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘ্নিত হয় প্রায়ই।

প্রতিটি কর্মদিবসই ঝুঁকিপূর্ণ

জনবহুল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার আদালত এলাকা থেকে গত দুই বছরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজনসহ পাঁচ আসামি পালিয়েছে পুলিশের হেফাজত থেকে। গত বছরের ২০ নভেম্বর সিজেএম আদালত ভবনের নিচ থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে করে পালিয়ে যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই দুর্ধর্ষ জঙ্গি। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিজেএম আদালত ভবনের মালখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১৯ সালের ৭ মার্চ ঢাকা জেলা জজ আদালতের (পুরনো ভবন) একটি লিফট নিচে পড়ে আইনজীবী, আদালতের কর্মচারীসহ ১২ জন গুরুতর আহত হয় এবং একজন মারা যান।

ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৯০টির বেশি ফৌজদারি আদালতে আসামি হাজির করতে ৪০০ জনের মতো পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করে কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। পরিস্থিতি সামলাতে তাদের বেকায়দা দশা হয়। স্বল্পায়তন ও জনবহুল এলাকা হওয়ায় নিরাপত্তা বিধান বা অন্য দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।

ডিএমপির উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. আনিসুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিআরবির বিধান অনুযায়ী নিরাপত্তার স্বার্থে আসামি আনা-নেওয়া করতে হবে জনসমাগমের বাইরে দিয়ে। কিন্তু তা কি করা যায়?’

অন্যদিকে নিরাপত্তা বা নিয়মিত সমস্যার বাইরে আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী ও আদালত-সংশ্লিষ্টদের বড় দুশ্চিন্তা অগ্নিকাণ্ড বা ভূমিকম্পের ঝুঁকি। সরেজমিনে দেখা গেছে, আদালতের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। ভবনগুলোতে নেই বিকল্প সিঁড়ি। আইনজীবীদের অভিযোগ, ভবনগুলোর বেশিরভাগ গড়ে তোলা হয়েছে তাড়াহুড়ো করে ও অপরিকল্পিতভাবে। আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে রক্ষা নেই।

ঢাকা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মিজানুর রহমান মামুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখানে যানজট ও জনবাহুল্য বড় সমস্যা। এখানে কয়েক সেকেন্ডের ভূমিকম্পে কী অবস্থা হবে ভাবা যায় না।’

২৪ বছর আগের উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি

একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ১৯৯৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে পুরান ঢাকার এই এলাকা থেকে আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার একটি উদ্যোগ নেয়। তখন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু (প্রয়াত)। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, ঢাকা বার, কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তখন আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে তৎপর হন। এজন্য কেরানীগঞ্জ, রাজধানীর বেগুনবাড়ী ও হাতিরঝিলের আশপাশের কিছু এলাকা এবং আগারগাঁওয়ের শেরেবাংলা নগর এলাকা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সরকারের পরিবর্তন ও পরবর্তী সময়ে উদ্যোগের ঘাটতি এবং আইনজীবীদের একাংশের আপত্তিতে উদ্যোগটি থমকে যায়। এর আগে-পরেও আদালত স্থানান্তর বা বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সম্ভব হয়নি।

২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত আইনমন্ত্রী ছিলেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তার সময়েও আদালত এ এলাকার অন্যান্য সরকারি স্থাপনা স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রবীণ এই আইনজীবী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইনজীবীদের অসুবিধা ও আপত্তির কারণে তখন তা সম্ভব হয়নি। এলাকাটি এখন আদালতের জন্য উপযুক্ত নয়। বাস্তবতা হলো, এখান থেকে স্থানান্তর করাটাও কিন্তু কঠিন কাজ। আমার মনে হয় এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যাতে বিচারপ্রার্থী, বিচারক ও আইনজীবীরা কিছুটা স্বস্তি পান।’

২৪ বছর আগের উদ্যোগের সময় ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আবু (এখন ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রধান কৌঁসুলি)। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, তখন উদ্যোগটি সফল হলে মানুষের ভোগান্তি লাঘব হতো। শত বছরের বেশি সময় ধরে এখানে বিচারকাজ চলছে। দিনে দিনে জায়গাটি ঘনবসতিপূর্ণ হয়েছে। আইনজীবীও বেড়েছে। বিচারপ্রার্থী বেড়েছে। ভবন ও এজলাস বেড়েছে। এখন চাইলেও আদালত স্থানান্তর কঠিন তবে অসম্ভব নয়।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আইন সাময়িকী ঢাকা ল রিপোর্টস-এর (ডিএলআর) সম্পাদক অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উপযুক্ত জায়গায় নেই আদালতগুলো। স্থানান্তর করলে ভালো হয়। তবে করবে কি না তা সরকারের পলিসির বিষয়।’



বার্তা সূত্র