গানের মাধ্যমেই তিনি আল্লাকে ডাকেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ান।
বুধবার ওই মামলায় অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়ে তিনি বেনারকে বলেন, “গান করি এবং গানের মাধ্যমেই আল্লাহকে ডাকি। গানের টাকায় আমার সংসার চলে।
তিনি বলেন, “বর্তমানে গান বন্ধ। ২০১৯ সাল থেকে সমস্যায় আছি। ২০২০ সালে পালাগানের আসর করতে পারিনি। খুব কষ্টে আছি।”
গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রিতা দেওয়ানসহ আরও দু’জনকে আসামি করে মামলাটি করেছিলেন আইনজীবী মো. ইমরুল হাসান।
মামলার অভিযোগে তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি ফেসবুক, ইউটিউবে দেখতে পান, রিতা দেওয়ান একটি পালা গানের আসরে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে মহান আল্লাহকে নিয়ে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।
পরবর্তীতে এ বিষয়ে পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গত ২ ডিসেম্বর রিতাসহ অন্য দুই আসামি শাজাহান ও ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।
বুধবার ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদনের শুনানিতে রিতা বলেন, “বাউল শিল্পীরা পালাগানের সময় একজন সৃষ্টিকর্তার অভিনয় করেন এবং অন্যজন জীবের অভিনয় করে সৃষ্টিকর্তাকে প্রশ্ন করেন। শতবর্ষ ধরে এই চর্চা চলে আসছে।”
তাঁর মতে, এটা আল্লাহকে অবমাননা করার জন্য নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে মানুষের মনে থাকা প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া হয়। এবং শেষে আল্লাহর কাছেই আত্মসমর্পণ করা হয়।
শুনানি শেষে আগামী ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করে আদালত। ওই দিন তাঁর স্থায়ী জামিনের আবেদন করা হবে বলে বেনারকে জানান রিতার আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
‘ভুল ধারণা থেকে মামলা’
রিতার অন্য আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “আদালতকে আমরা বলেছি মামলাটি ভুল ধারণা থেকে করা হয়েছে। রিতা দেওয়ান পালাগানে যে অভিনয় করেছিলেন তার খণ্ডিত অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে মামলাটি করা হয়েছে।”
“পালাগানের পুরোটা ছিল সাড়ে চার ঘণ্টার। সেখান থেকে কেটে মাত্র ৭ মিনিটের একটি ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করা হয়,” জানিয়ে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “রিতা দেওয়ান ওই ভিডিও করেননি বা তিনি নিজে ইন্টারনেটে আপলোডও করেননি। কাজেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ হতে পারে না।”
তিনি বলেন, “আল্লাহকে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে বাউলরা পালাগান করেন না। সেখানে দুটো পক্ষ থাকে। একপক্ষ জীবের অভিনয় করেন এবং অন্যপক্ষ পরমের (সৃষ্টিকর্তার) অভিনয় করেন। যিনি জীবের অভিনয় করেন তিনি মানুষের পক্ষে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেন। সুফিবাদী চর্চায় এটি অপরাধ নয়।”
“আমরা আল্লাহর বন্দনা করে পালা শুরু করি এবং আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেই পালা শেষ করি। মাঝখানে গানের মাধ্যমে পাল্টাপাল্টি যুক্তি দেওয়া হয়। মানুষকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এই বিতর্ক,” বুধবার আদালতে বলেন রিতা দেওয়ান।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি আদালতে জানান, “সেদিন আমি জীবের ভূমিকায় গান করেছি। গানের সামান্য একটি অংশ দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।”
তবে এই ধরনের চর্চা চলতে পারে না বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন মামলার বাদী এডভোকেট মো. ইমরুল হাসান।
বুধবার রিতা দেওয়ানের আত্মসমর্পণের সংবাদ না জানলেও ২৭ জানুয়ারি শুনানিতে অংশ নেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “গান হোক আর কবিতা হোক, যেখানে আল্লাহ সম্পর্কে কটূক্তি হয় সেসব চলতে পারে না। এসব বন্ধ হওয়া উচিত। এসব বন্ধের জন্য আমি আবার মামলা করব।”
এদিকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে পৃথক একটি মামলায় রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে কিনা সে বিষয়ে আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য রয়েছে।
বাংলা একাডেমির উপপরিচালক লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ড. তপন বাগচী বেনারকে বলেন, “যে রাজাকারের ভূমিকায় অভিনয় করবে, সে তো অভিনয়কালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই কথা বলবে। তাকে কি রাষ্ট্রদ্রোহী বলা যাবে? শিল্প-সংস্কৃতির এই স্বাধীনতা আছে। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়।”
“রিতা দেওয়ান ওই কাজটিই করেছিলেন। বয়াতির গানে একই ব্যক্তি একাধিক সত্তার অভিনয় করেন। মানুষের নেগেটিভ সত্তার অভিনয়ে নেগেটিভ বক্তব্য দিয়ে তিনি মানুষকে জাগাতে চেয়েছিলেন। এর অর্থ এটা নয় যে তিনি নিজেও তাই বিশ্বাস করেন,” বলেন তিনি।
ড. তপন বাগচী বলেন, “শতবর্ষ বছর যাবত বাউল সাধক ও পালাকাররা এই চর্চা করে আসছেন। অতীতের সকল বিখ্যাত পালাকার ও সুফি সাধকেরা এভাবেই এদেশে ধর্ম প্রচারের কাজ করেছেন। এই লোকসংস্কৃতি বাংলার ঐতিহ্য।”
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে ১৩০টি মামলা হয়। এসব মামলায় আটক হন ২৭১ জন।