বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিমালা প্রয়োগের বিষয়ে, রাষ্ট্রদূত পিটার হাস-এর সাম্প্রতিক মন্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্পাদক পরিষদের (সম্পাদক পরিষদ) গত ২৭ সেপ্টেম্বর এক চিঠি দিয়েছিলো ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে। শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, এ চিটির জবাব দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস।
বিবৃতিতে জানানো হয়, চিঠির জবাবে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং ‘সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের মত প্রকাশের অধিকার’ রক্ষায় তার সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, “গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।”
রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, “এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ যেকোনো সরকারের সমালোচনামূলক মতামত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা আমাদের নীতির যে কোনো উপাদান সম্পর্কে জনসাধারণের স্বার্থের প্রতিফলনকে স্বাগত জানাই।”
সম্প্রতি বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন, চ্যানেল টুয়েন্টিফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিমালার আওতায় গণমাধ্যমও আসতে পারে বলে রাষ্ট্রদূত হাস উল্লেখ করেছিলেন। তার এমন বক্তব্যের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়ে, সম্পাদক পরিষদ,বাংলাদেশ এর সভাপতি মাহফুজ আনাম একটি চিঠি দিয়েছিলেন। এর জবাবে রাষ্ট্রদূত হাস এ কথা বলেন।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর, চ্যানেল-২৪ কে দেয়া সাক্ষাৎকারে পিটার হাস বলেছিলেন, “আমরা নীতিটি যে কারো বিরুদ্ধেই ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে প্রয়োগ করছি। তারা হোক সরকারপন্থী, বিরোধী দলে থাকুক না কেন, বা তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যই হোক না কেন, এমনকি তারা বিচার বিভাগে থাকুক বা গণমাধ্যমে থাকুক।”
চলতি বছরের ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে এবং ২২ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করা হয় যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর পিটার হাসকে লেখা চিঠিতে মাহফুজ আনাম লিখেছেন, “গণমাধ্যমের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উপরোক্ত মন্তব্যে বিষয়ে তার মনে এবং সম্পাদক পরিষদের সদস্যদের মনে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায় তিনি চিঠি লিখছেন। ই-মেইলে আনাম লিখেছেন, “সত্যি বলতে কী, এই মন্তব্য আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে, আমাদের অনুরোধ থাকবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার।”
চিঠিতে তিনি আরো উল্লেখ করেন, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং রাষ্ট্রদূত ব্যক্তিগতভাবে সবসময় স্বাধীন গণমাধ্যমের অবিচল সমর্থক, তাই এই মন্তব্য তাদের বিচলিত করেছে।
ভিসা বিধিনিষেধ, “ব্যক্তির কর্ম ছাড়া অন্য কিছুর ওপর ভিত্তি করে নয়”; যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের এই বক্তব্যের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেন মাহফুজ আনাম। তিনি আরো উল্লেখ করেন, “গণমাধ্যমের ‘কাজ’ লেখা বা সম্প্রচার করা।” চিঠিতে তিনি জানতে চেয়েছেন যে একজন সাংবাদিক যা লেখেন বা সম্প্রচার করেন তার ওপর ভিত্তি করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা হবে কিনা।
“যদি তাই হয়, তাহলে এটা কি ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ এবং ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’র আওতায় পড়ে না? গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে এটি কীভাবে ব্যবহার করা হবে? কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে?”- চিঠিতে জানতে চেয়েছেন মাহফুজ আনাম।
আনাম লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জন্য সবসময় অনুপ্রেরণা ও অনুকরণের উৎস হিসেবে কাজ করেছে। সেক্ষেত্রে ভিসা নীতি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলে, প্রথম সংশোধনীর মূল্যবোধ কীভাবে প্রতিফলিত হবে।”
জবাবে পিটার হাস লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে এবং যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ণ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে এবং তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি প্রয়োগ করবে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, “অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের।গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যেক-কে নিজ নিজ ভূমিকা পালনের সুযোগ দিতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হাস আরো বলেন, “পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের বক্তব্য স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুন্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য।এর মধ্যে যারা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে পদক্ষেপ নেয় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”