বিএনপি দেশটিকে কি করতে চায় তা তাদের কখনো হাস্যকর, কখনো অযৌক্তিক কথা-মন্তব্য-বক্তব্য-দাবি ইত্যাদির দ্বারা সুনির্দিষ্ট হয় না। বরং মনে হয়, সুদূর থেকে আসা কাল্পনিক অবাস্তব কিন্তু দেশবিরোধী বার্তা গিয়ে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পুতুল নাচের প্রহসন মঞ্চস্থ হচ্ছে। জনগণকে বুঝতে হবে- দলটির নির্বাসিত নেতা এবং ফৌজদারি অপরাধের বিচারে দ-িত নেত্রী। এ দুজন ২০০১, ২০১৪-১৫, ২০১৮-এর নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলার মতো অবস্থা তৈরি করেছিল। নেপথ্যে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ছিল?
বিএনপি নামের দলটির নেতা-নেত্রী আদৌ সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে কিনা!
জিয়াউর রহমান বিএনপি কি উদ্দেশ্যে গঠন করেছিল- মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মবেশে জামায়াতি-পাকিস্তানি লক্ষ্য পূরণের জন্য কি? তাই যদি না হবে তাহলে ক্ষমতা গ্রহণ করেই সেনাবাহিনীকে ‘মুক্তিযোদ্ধা-মুক্ত’ করার কাজ শুরু করবে কেন? কেনই বা সংবিধানে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে পুনর্বাসিত করে?
কেনই বা এরশাদ আমলে আওয়ামী লীগসহ বিএনপি ’৮৬-এর নির্বাচনে যোগ দেওয়ার অঙ্গীকার করে নির্বাচনের আগের রাতে খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল? এটি তো ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। জনগণ মনে করে, সব সময় আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকামী দল। দলটির নেত্রী জনগণের দাবি তুলতে জাতীয় সংসদে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন তখনও। আজও দলটি নির্বাচনমুখী। ২০০১-এর চরম নির্যাতন-নিপীড়ন, ফল পাল্টানোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা-কর্মকা-ের ভেতরেও শেখ হাসিনা দলকে নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি ভোট বর্জন করেননি, নির্বাচনী ফলও প্রত্যাখ্যান করেননি।
হাস্যকরভাবে বর্তমান বিএনপি নেতৃবৃন্দ ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলে নির্বাচন বর্জনের আন্দোলন করছে। বাস্তবে গণতন্ত্র চর্চার ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচন। যে দাবিতে বিএনপির আন্দোলন সেটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যারা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিএনপিই ধ্বংস করেছিল। ২০০৬-০৭ এ খালেদা জিয়া ‘দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ গঠনে এমনই নির্লজ্জ আচরণ করেছিল যে, তাকে, পুত্র তারেককে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রায় উন্মাদ হতে দেখা গেছে। এখন আবার তারা কোনমুখে ওই ব্যবস্থাটিকে আবারও ফিরিয়ে আনতে চাইছে? বিএনপি এ পথে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব ভাবছে বলেই সন্দেহ হয়।
নির্বাচন বর্জন একবার নয়, বারবার করে বিএনপি জনগণকে একটি বার্তাই দেয় যে, দলটি এখনো রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গড়ে ওঠেনি। কারণ, যে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী থাকে জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্য এবং তাদের রাজনীতির তাদের রাজনীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। তাছাড়াও নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাণবীজ। নির্বাচন না করলে সে দলের ভেতরেও গণতন্ত্র লোপ পেয়ে সে স্থান অধিকার করে স্বৈরতন্ত্র। দলের অনুসরণকারী, সমর্থক, এমনকি প্রার্থী হতে চাওয়া ব্যক্তি, মানুষ নিরাশ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর জন্ম দেয় বা দিতে পারে। যারা নির্বাচনমুখী, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের প্রার্থী, সদস্য, সমর্থক, এমনকি নির্বাচন পরিচালনায় অংশগ্রহণকারী রিটার্নিং অফিসার, প্রেসাইডিং অফিসার, নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা-নির্যাতন করে থাকে। এ ঘটনা গণতন্ত্র নয়।
বিএনপি সম্পর্কে জনমানুষের সব শ্রেণি পেশার মানুষের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু তাদের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচন বর্জনের সঙ্গে নির্বাচন প্রতিরোধের হুমকিও দিয়েছেন! এ কথা অনস্বীকার্য যে, বর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক পেয়ে যারা এ দলের পেশিশক্তি, সন্ত্রাসী তারা এ কাজে বিপুল উৎসাহ পেয়ে উন্নয়নের পথে যাত্রা করা দেশটির এবং নির্বাচনে যোগ দেওয়া দলগুলোর নেতৃত্ব, সদস্য, সমর্থকদের ওপর হামলে পড়ার সুযোগ গ্রহণ করবে।
ওপরে বর্ণিত দেশের বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশকে আবারও অস্থিতিশীল করে ধ্বংস, ক্ষতি, হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করার সুযোগ বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের গ্রহণ করা রীতিমতো অন্যায় হবে। দেশমাতৃকাকে ভালোবাসা দিতে না পারলে অন্তত তার চরম ক্ষতি যেন বিএনপির সন্ত্রাসীরা না করেÑ তা নিশ্চিত করতে অনুরোধ করব। কথা হলো- বিএনপির বর্তমান নেতৃবৃন্দ এসব বিষয়ে কি অজ্ঞ? তা তো হতে পারে না।
তাহলে প্রশ্ন, তাঁরা জেনে, বুঝে দেশ, জাতি এবং সুস্থ রাজনীতিকে বিসর্জন দিচ্ছে কার স্বার্থে? কার নির্দেশেই বা তারা পুতুল নাচ প্রদর্শনে লজ্জিত হচ্ছে না? তাদের কাছে- ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে জাতি ও জনগণ বড়, জনগণের চেয়ে দেশ বড় এবং দেশ শাসনে ‘গণতন্ত্র’ সবচেয়ে ওপরে, এ নীতি বহুদূরে নয় কি?
বিএনপি নেতৃবৃন্দ সবাই শিক্ষিত। তারা প্রথমত, বারবার নির্বাচন বর্জন করতে পারেন না, যদি প্রকৃত রাজনীতিক হন। দ্বিতীয়ত, তারা যদি নির্বাচন বর্জনই করে তাহলে তাঁরা ২০০১, ২০১৪, ১৫, ২০১৮-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্যাডারদের নির্বাচন প্রতিরোধের বর্বরতা দেখিয়েছেন কেন? উপরন্তু শাপলা চত্বরে জামায়াত-হেফাজত, বিএনপির ক্যাডার দ্বারা মতিঝিল এলাকার ধ্বংস হওয়ার চিত্রও নিশ্চয়ই দেখেছে। তাই এ পথে তারা যাবেন না বলে জনগণ প্রত্যাশা করে।
বিএনপিকে এখন আর রাজনৈতিক দল বলে গণ্য করে না অধিকাংশ জনগণ। এ দলের নেতাদের বক্তৃতা অধিকাংশ সময় ক্যারিকেচার বলে জনগণ মনে করছে। তারা যে ধরনের হাস্যকর নাটক করুন না কেন, বিগত বছর থেকে তাদের সভা-সমাবেশ-জমায়েতে বিপুল জনসমাগম দেখা যাচ্ছে। জনগণ যখন জানে, জানতে পারছে, দেখছে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না, তারপরও কেন, কি কারণে জনতা এসব সমাবেশে যোগ দিচ্ছে- এটাও অনেককে ভাবাচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে পণ্যমূল্য কমাতে পারবে- এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে খাদ্য উৎপাদন বিঘিœত হচ্ছে যুদ্ধ-সংঘর্ষ খাদ্য জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করছে।
ব্যবহারিক পণ্যের রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের যেমন গার্মেন্টস, চামড়া শিল্পে রপ্তানি কমছে। খাদ্যশস্য উৎপাদক দেশগুলো, জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলো কিছুটা স্বস্তিতে আছে। তবে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, চাকরি কমে যাওয়া, তথ্যপ্রযুক্তি অনেকাংশে জনমানুষের স্থান নিয়ে নেওয়া কোনো সরকারকেই স্বস্তি দিচ্ছে না। আমরা আশ্চর্যান্বিত হই যখন দেখি, এই তুমুল কঠিন সমস্যার মুখেও শত শত অনিয়ম, দখলদার দুর্নীতিবাজদের অপকর্মের মধ্যে প্রিয় মাতৃভূমি ও জাতিকে উন্নয়নের পথে নিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু যেমন দুবার জন্মাবেন না, তেমনি শেখ হাসিনাও দুবার এ দেশে জন্ম নেবেন না। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, বিএনপির এই নেতারা কি মনে মনেও শেখ হাসিনাকে স্বীকৃতি দেন না? নিশ্চয়ই দেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি আমরা টের পাচ্ছি। উচ্চমাত্রার উষ্ণতা জনমানুষকে কষ্ট দিয়েছে। মানুষ মারাও গেছেন- উষ্ণতা ও বজ্রাঘাতে। সেজন্য আমাদের চিন্তাÑ পৃথিবী, দেশ সুপেয় জলের ভা-ার নদী, তার উৎস হিমবাহ এবং জলের ওপর নির্ভরশীল যেসব প্রাণÑবৃক্ষ থেকে পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ এবং মানুষ, সবাই আসলে একটা ক্রান্তিকালে উপস্থিত হয়েছি। এ মহাসংকটে আমরা জ্ঞান-প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যাবার যাত্রা পথে রাজনীতির নামে হাস্যকর, অন্যায়, অন্যায্য কর্মকাণ্ড না করে সব দেশে-পাশ্চাত্যের দেশ বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, এশিয়ার দেশ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া সব দেশে যেমন কোনো দল নির্বাচন বর্জন করে না, তেমনি আমাদের দেশেও সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে- এটাই আশা করি।
এর বাইরে বিশ্বের কোনো দেশে কোনো সময় কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে, এমন দেখা যায়নি। বর্জনও দুর্লভ ঘটনা। প্রতিহত করা তো বে-আইনি যা কোনো দল কোনো দেশে করে না। প্রতিহত করে নিজেদেরকে কলঙ্কিতও করে না। নির্বাচন বর্জন যদি কোনো দলের অধিকার হয়, হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা তো নেতৃবৃন্দের দ্বারা সংঘটিত একটি সিভিল অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা। সংবিধানে প্রতি পাঁচ বছর পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান আইন হিসেবে লিখিত আছে। এটি প্রতিহত করার ঘোষণা অসাংবিধানিক কাজ হিসেবে গুরুতর অপরাধ। এটি ঘোষণা করাও সেজন্য অসাংবিধানিক। দেশের আইন ভঙ্গ করার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে বলে মনে করি। তাদের এই অসাংবিধানিক ঘোষণা-কাজ ও কর্মকা-ের বিরুদ্ধে আদালতে রিট হতে পারে নিশ্চয়ই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা রাজনীতি অব্যাহত রাখতে চাইলে, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে প্রথমত, তাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জনগণকে দেখাতে হবে যে, তারা প্রকৃতই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকে ‘প্রতিহত’ করার ঘোষণার মতো অপরাধমূলক ঘোষণা দেবেন না। প্রতিহতের নামে ‘অরাজকতা’ করতে, সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করতে, সর্বোপরি দেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইবেন না। তাছাড়া, কোনো দল যদি রাজনীতি করে, তাহলে তারা কতবার নির্বাচন বর্জন করতে পারবে- এটি নির্বাচন কমিশন এবং দেশের সুশীল ব্যক্তি, সব দলের রাজনীতিকরা মিলে সুনির্দিষ্ট করবেন।
কারণ, কোনো দল বারবার নির্বাচন বর্জন করেও রাজনৈতিক দল হিসেবে রাস্তা-ঘাটে সভা করে জনদুর্ভোগ তৈরি করবে, তা করতে দেওয়া যায় না। নাগরিকদের অধিকার খর্ব হয় এতে। তাছাড়াও রাজনীতির অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্তব্যসহ সংবিধান মান্য করতে হবে।
‘নির্বাচন প্রতিহত’ করা আইনিভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশকে বারবার ‘নির্বাচন প্রতিহতের নামে কোনো দল স্বেচ্ছাচারিতা দ্বারা ধ্বংস করবে, অন্য দলের নেতাকর্মী হত্যা করবে, সংখ্যালঘুদের ওপর লুটপাট, দখল, ধর্ষণ, এলাকা ছাড়া করার মতো অপরাধের মূলোৎপাটন করবে তা হতে পারে না। এ বিষয়ে সব দলের রাজনীতিকরা চিন্তাভাবনা করবেন বলে আশা করি।
স্বাধীনতার ৫২ বছর হয়ে গেল তারপরও এসব অগণতান্ত্রিক আচরণকে আর চলতে দেওয়া যায় না। এটি অনেক বেশি দিন চলেছে, যা অনেক আগেই বন্ধ হওয়া উচিত ছিল। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন করে বিতর্কিত করাই বিএনপির নেতৃত্বের লক্ষ্য। তাদের লক্ষ্য-জয়-পরাজয় নয়, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিদেশী ও দেশীদের চোখে বিতর্কিত করা। নির্বাচনী মাঠে প্রতিযোগী না থাকলে আওয়ামী লীগ বা সরকারের নির্বাচন নিয়ে দায় অনেক কমে যায়Ñএটিও বিএনপিকে ভাবতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ