Skip to content

কারাম উৎসবে নেচে-গেয়ে মঙ্গল প্রার্থনা

সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে বাজতে থাকে ঢাক-ঢোল আর মাদল। সঙ্গে ডুগডুগি, খঞ্জনি আর কাঁসর। কারাম গাছকে ঘিরে পূজা অর্চনায় হেলে দুলে নেচে-গেয়ে শুরু হয় উৎসব। প্রতিবছর এভাবেই ভাদ্র মাসের একাদশীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা উদযাপন করে তাদের ধর্মীয় উৎসব ‘কারাম’। নিজস্ব সংস্কৃতির রেশে শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ নানান বয়সী মানুষ নেচে গেয়ে মেতে ওঠেন এ উৎসবে।

বছরের পর বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব পালন করে আসছেন রংপুর নগরীর ওরাওঁ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর শেখপাড়ার আদিবাসী পল্লিতে পালন করা হয় ১৭৩তম কারাম পূজা ও সামাজিক এ উৎসবটি।

নেচে-গেয়ে আর কেজ্জায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা কারাম উৎসবের মাধ্যমে বিপদ থেকে মুক্তি, অতিবন্যা ও খরা থেকে বাঁচতে দেশ ও মানুষের মঙ্গল কামনা করেন। উৎসবটি দেখার জন্য ওরাওঁ সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও সমবেত হন আদিবাসী পল্লিতে।

কারাম মূলত একটি বৃক্ষ। বাংলা বছরের ভাদ্র মাস এলেই এই বৃক্ষের ডাল নিয়ে একটি নির্ধারিত স্থানে পুঁতে রেখে সেখানে দুধ ছিটিয়ে জ্বালানো হয় ধূপ। পুঁতে রাখা কারামের ডাল ঘিরে চলে নৃত্যযোগে ধর্মীয় কেজ্জাপঠন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপদ থেকে নিজ নিজ সম্প্রদায়কে রক্ষার আকুতির সঙ্গে দেশ ও মানুষের মঙ্গল কামনা প্রাধান্য পায় কারাম উৎসবে। এ কারণে ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবকে ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি সামাজিক উৎসব হিসেবেও গুরুত্ব দিয়ে আসছে সমতলে থাকা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা।

শেখপাড়া আদিবাসী পল্লিতে ওরাওঁ সম্প্রদায়ের একশর বেশি পরিবার রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই কৃষিকাজ নির্ভর। বেশ কয়েকটি পরিবারের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আলোয় নিজেদের জীবন বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ সচেতনতার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছেন। তবে এই পল্লিতে নিম্নআয়ের পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে উৎসবের দিনেও কখনো কখনো অনেকের পরনে জোটে না নতুন কাপড়। তবে আনন্দ ভাগাভাগিতে কারও কোনো কমতি নেই। যেন ছোট-বড় সববয়সী মানুষের মিলন মেলা কারাম উৎসব।

ওরাওঁ সম্প্রদায়ের লোকেরা জানান, সপ্তাহখানেক আগে থেকেই চলতে থাকে পূজার প্রস্তুতি। পূজার আগের রাত থেকে শুরু হয় উপবাস। এটা শেষ হয় তিনদিন পর কারাম গাছ বিসর্জনের মধ্যদিয়ে। এ উৎসবে অনেক আনন্দ হয়ে থাকে। নিজেদের পাশাপাশি দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা করা হয় কারাম উৎসবে। তাদের পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করতো কারাম পূজার মাধ্যমে সব বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায়, এ জন্য বংশ পরমপরায় তারাও প্রতি বছর ঘটা করে এই উৎসবটি পালন করে আসছে।

সেখানকার উত্তর শেখপাড়ার বাসিন্দা রতন টপ্য বলেন, কারাম আমাদের সবচেয়ে বড় একটি উৎসব। এই উৎসবে আমরা অনেক আনন্দ করে থাকি। আমাদের সবার বাড়িতে মেহমান আসছে। বাড়ি বাড়ি পিঠা-পুলিসহ মজাদার খাবার তৈরি হয়। আমরা ছোট-বড় সবাই মিলে অনেক আনন্দ করে থাকি। প্রকৃতির দেবতা আমাদের বছরের পর বছর ধরে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে আসছেন, তাদের কারাম পূজার মাধ্যমে বিপদ থেকে মুক্তির প্রার্থনা করি।

আদিবাসী পল্লিতে প্রায় সাত বছর ধরে উত্তম কুমারের বসবাস। তিনি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যরকম সখ্য তার। প্রতিবছরের মতো এবারো কারাম উৎসব দেখতে এসেছিলেন তিনি। তার মতো বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই উৎসবের আয়োজন দেখতে আদিবাসী পল্লিতে আসেন।

উত্তম কুমার বলেন, প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবটি এখনকার ওরাওঁ সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা পালন করে আসছে। কারাম গাছের ডালকে তারা রক্ষাকবজ মনে করেন। সেজন্য কারাম গাছের পূজা-অর্চনা করে ওরাওঁ সম্প্রদায়। সন্ধ্যার পর থেকে সারারাত তারা নেচে-গেয়ে আর কেজ্জা পাঠ করে থাকে।

অভিভাবক বিলকিজ রানি বলেন, আমাদের বাচ্চারা এই উৎসবের দিনেও স্কুল-কলেজে যায়, কারণ তাদের ছুটি নেই। আমরা মনে করি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মতো আমাদেরও ধর্মীয় উৎসব পালনে এই দিনটিতে বাচ্চাদের ছুটি থাকা প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের এখন থেকে এসব উৎসবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে না দিতে পারি, তাহলে এটা একসময় বিলুপ্ত হতে পারে। এজন্য আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি উদ্যোগে পাঠপুস্তকে কারাম অন্যান্য উৎসবের কথা তুলে আনা উচিত।

স্থানীয় শিক্ষার্থী চন্দনা ধানোয়ার বলেন, কারাম উৎসব আয়োজন নিছক বিনোদনের জন্য করা হয় না। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের পাশাপাশি আমাদের মতো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার বিশেষ উদ্যোগ এই উৎসব। আগে ছোট আকারে কারাম উৎসব হলেও এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক পরিসরে এটি হয়ে আসছে। এই দিনে আমরা ভীষণ আনন্দ করি ।

আদিবাসী পল্লির হিরোয়াশি জেএসসি ফুকুই বৌদ্ধ বিহার সভাপতি রুবেল ধানোয়ার বলেন, এটি ১৭৩তম কারাম উৎসব। আদি সময় থেকে যারা আমরা ওরাওঁ আদিবাসী তারা এ কারাম পূজাটি পালন করে আসছি। কারাম বৃক্ষকে পূজা করার মাধ্যমে আমরা মনে করি আমাদের সব বিপদ-আপদ দূর হয়ে যাবে। দেশের মানুষের মঙ্গল হবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এ আয়োজনকে আরও ভালো করে করার জন্য। তবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা ভালোভাবে এ উৎসবটি পালন করতে পারবো।

রংপুর জেলা আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সভাপতি টিউলিপ এক্কা বলেন, কারাম উৎসব সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব। ওরাওঁ, সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহান, মালো, মাতোসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব কারাম উদযাপন করা। আমরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে আনন্দ করি। পরের দিন কারাম গাছের ডালটি পুকুরে নয়তো নদীতে বিসর্জন দেওয়ার মধ্যদিয়ে আমাদের উৎসব শেষ হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, সরকার আমাদের মতো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের জীবনমানের উন্নয়নে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমরা সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া অনুভব করছি। আমরা চাই এই উৎসবের দিনে আমাদের জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক। একই সঙ্গে আমাদের আদিবাসীর স্বীকৃতি দেওয়া হোক।  

ওরাওঁ সম্প্রদায়ের ১৭৩তম এই কারাম উৎসবে প্রতি বছরের মতো এবারো সহযোগিতা করেছেন জানিয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামছুল হক বলেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের কারাম পূজাটি ঐতিহ্যবাহী বড় একটি উৎসব। প্রতি বছরে তারা নানা আয়োজনে এ উৎসবটি পালন করে থাকেন। তাদের সব আয়োজনে আমি পাশে থেকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে আসছি। এ ধরনের সামাজিক ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব আমরা উপভোগ করি এবং আমার খুব ভালো লাগে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসএম



বার্তা সূত্র