Skip to content

কারামুক্ত কার্টুনিস্ট কিশোর জানালেন, ‘ভালো নেই,’

“পিটিয়ে কানের পর্দা পর্যন্ত ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে”

বেনার নিউজ

গ্রেপ্তারের পর তাঁকে অনেক নির্যাতন করা হয়েছিল বলে মুক্তি পাবার পর অভিযোগ করেছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। ওই নির্যাতনের কারণে তাঁর কানের পর্দা পর্যন্ত ফেটে গেছে বলে বেনারকে জানান তিনি।

বুধবার হাইকোর্ট থেকে জামিন পাবার পর বৃহস্পতিবার কাশিমপুর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কিশোর।

হাসপাতাল থেকে টেলিফোনে বৃহস্পতিবার কিশোর বেনারকে জানান, তিনি “ভালো নেই।”

“বাম পায়ে ভীষণ ব্যথা। পায়ে অনেক মেরেছে। কানের পর্দা ফেটে গেছে। চোখে ঠিক মতো দেখি না। দাঁতেও ব্যথা,” বলেন কিশোর।

‘নির্যাতনে’ই তাঁর কানের পর্দা ফাটা ও দাঁতে ব্যথার কারণ জানিয়ে আটকের পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা তাঁর পায়ের তালুতে পিটিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন কিশোর।

পুলিশ কিশোরকে ২০২০ সালের ৬ মে গ্রেপ্তারের কথা জানালেও এর চার দিন আগে লালমাটিয়ার বাসা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় জানিয়ে কিশোর বলেন, “২ মে ২০২০ তুলে নেয়া হয়েছে। ৬ মে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।”

“২ মে রোজা ছিলাম। ওরা ইফতারি করতে দেয়নি। আমি এখন দিকও বুঝতে পারি না। খুব অসুস্থ। পায়ের তালুতে অনেক পেটানো হয়েছে।”

কখন নির্যাতন করা হয়েছে—এই প্রশ্নের জবাবে কিশোর বলেন, “গ্রেপ্তারের পর নির্যাতন করা হয়েছে।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একই মামলায় আটক লেখক মুশতাক আহমেদ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারা হেফাজতে মারা যান। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, মুশতাক ‘রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের’ শিকার।

কারা হেফাজতে মুশতাকের মৃত্যুর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কার্যকারিতা স্থগিত করে এর বিভিন্ন ধারা পর্যালোচনার জন্য এক বিবৃতিতে সরকারকে পরামর্শ দেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মিশেল ব্যাশলে।

এছাড়া ওই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় ঢাকার বিদেশি দূতাবাসগুলোসহ বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন লেখক মুশতাকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আর কিশোরকেও কোনো নির্যাতন করা হয়নি।

“কিশোর অথবা লেখক মুশতাক কাউকেই নির্যাতন করা হয়নি। এগুলো অসত্য কথা,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তবে গ্রেপ্তারের পর কিশোরের ওপর নির্যাতনের কথা আদালতেও জানানো হয়েছে বলে বেনারকে জানান কিশোরের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

তিনি বলেন, “উনাকে কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছে বলে উনি আমাকে জানিয়েছেন। আমরা আদালতকেও এই কথা জানিয়েছি।”

তবে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটনের মতে কারাগারে নির্যাতনের সুযোগ কম, নির্যাতনের ঘটনা সাধারণত আটকের পরপরই ঘটে থাকে।

তিনি বলেন, “পুলিশ-র‌্যাব যা করে তা হলো, আটকের পরেই পেটায়। পিটিয়ে তাদের ইচ্ছামত স্বীকারোক্তি আদায় করে এরপর আটক দেখায়। আটক দেখানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা আসামিকে আদালতে উপস্থাপন করে।”

“কারাগারে নির্যাতনের ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। কিন্তু সেখানে নির্যাতনের সুযোগ কম। কারণ যাকে নির্যাতন করা হবে তাঁকে অনেক মানুষ থেকে আলাদা করে আলাদা স্থানে নির্যাতন করাটা কঠিন,” বলেন লিটন।

সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের দায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় আটক হন কারাগারে নিহত লেখক মুশতাক এবং কার্টুনিস্ট কিশোর।

মে মাস থেকে মুশতাক ও কিশোরের জামিন আবেদন ছয়বার নাকচ হয়ে যায়। মুশতাকের মৃত্যুর পর আবেদন করলে সপ্তমবারের চেষ্টায় জামিন মেলে কিশোরের। বুধবার কিশোরকে জামিন দেয় হাইকোর্ট।

কিশোরের “ডায়াবেটিস আছে। কিন্তু কারাগারে চিকিৎসা না দেয়ায় তাঁর ডায়াবেটিস বেড়ে গেছে। কান থেকে পুঁজ বের হচ্ছে,” জানিয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বলেন, “তাঁর ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন।”

‘মুশতাকের মৃত্যু স্বাভাবিক’

কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বুধবার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “প্রতিবেদনটি আমি দেখেছি।”

তিনি বলেন, “প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেখক মুশতাক আহমেদ স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাঁর শরীরের কোনো অংশেই কোনো প্রকার আঘাত বা নির্যাতনের চিহ্ন নেই।”

সুনির্দিষ্টভাবে কোন কারণে তিনি মারা গেছেন সেব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, “আমরা এখনও পোস্ট মর্টেম (সুরতহাল) প্রতিবেদন পাইনি। ওই রিপোর্ট পেলে আমরা কারণ বলতে পারব।”

২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কাশিমপুর কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিতর্ক ও আন্দোলন।

মৃত্যুর কারণ জানতে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটি বুধবার প্রতিবেদন জমা দেয়।

পুলিশের অভিযোগ, মুশতাক, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরসহ অন্যান্যরা সরকারের করোনাভাইরাস মহামারি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ‘মিথ্যা তথ্য’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছেন। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু, মুজিববর্ষসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মনগড়া ও ভিত্তিহীন অপপ্রচার চালিয়েছেন, যা দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এই ‘অপরাধের’ দায়ে গত বছর ৫ মে তাঁদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ। পরদিন মুশতাক ও কার্টুনিস্ট কিশোরকে আটক করে র‌্যাব।

বৃহস্পতিবারও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মুশতাক আহমেদের মৃত্যু ‘রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড’।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “তাঁরা তো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই কথা বলেছেন। রাষ্ট্র কেন তাঁকে হত্যা করবে। উনি জেল থেকে রাষ্ট্রের কী ক্ষতি করছেন?”

মুশতাক আহমেদের স্ত্রী লিপা আখতার বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “মুশতাকের ভাই নাফিজ রহমান একজন ডাক্তার। তিনি নিজে পোস্টমর্টেম করার সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, মুশতাকের ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল বলে মনে হয়। মৃত্যুর সময় ওর হার্টের আকার ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়ো।”

তিনি বলেন, “উনাকে ২৩ ফেব্রুয়ারি জামিন দিলে উনি আমাদের মাঝে থাকতেন। মারা গেলে আমাদের কাছেই মরে যেতেন। কিন্তু জেলখানায় মারা যেতেন না।”

লিপা আখতার বলেন, “আমরা জানি না উনি অসুস্থ হওয়ার কত সময় পর হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কি না।”

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, “আমার মনে হয়, পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদন পাওয়ার আগে শুধু সুরতহাল প্রতিবেদন দেখে বলা যায় না তিনি কী কারণে মারা গেছেন। মন্ত্রী যখন বলে দিলেন যে তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তখন আর প্রকৃত একটি পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।”