কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় হঠাৎ করেই ধর্মঠাকুরের পুজা শুরু করে সাড়া ফেলে দিয়েছে কলকাতার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি গোষ্ঠী। শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে পাঁচদিন ধরে চলবে এই ধর্মঠাকুরের পুজো। কিন্তু কে এই ধর্মতলার ধর্মঠাকুর যার কথা সেভাবে শোনা যায়নি বহুদিন?
ধর্মঠাকুর আসলেই কি সনাতনী হিন্দুদের দেবতা, না কি তিনি বৌদ্ধদের অথবা ডোম, বাগদিদের মতো অন্ত্যজ শ্রেণীর আরাধ্য দেবতা? ঘটনাচক্রে সনাতন ধর্মের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ব্রাহ্মণরাই পুজা করে থাকেন। কিন্তু এ ধর্মঠাকুরের পুজা করেন ডোম, বাগদিদের মতো অন্ত্যজ শ্রেণীর পুরোহিতরা – যাদের ‘ডোমপণ্ডিত’ বলে সম্বোধন করা হয়। কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চলে ধর্মঠাকুর পুজার মূল উদ্যোক্তা স্বামী সর্বানন্দ অবধূত বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, ‘সনাতন ধর্মের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে আমাদের এই বাংলা থেকে। প্রথমে মুসলমান শাসকরা, তারপরে ব্রিটিশ শাসকরা মুছে দিয়েছে আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্মের অনেক ঐতিহ্য।’
‘ইতিহাস ঘেঁটে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কলকাতার ধর্মতলায় একটা সময়ে ধর্মঠাকুরের পুজো হত ব্যাপক ভাবেই। পাশ দিয়েই গঙ্গা প্রবাহিত হত, আর ওই অঞ্চলে বসবাস করত জেলে আর আদিবাসীরা। তারাই আদিকালে ধর্মঠাকুরের পুজো করত শিলাখণ্ডে। সেই প্রথা সনাতন ধর্মে চলে আসছে। আমরাও শিলাখণ্ডকেই পুজো করছি ধর্মতলায়,’ বলছিলেন স্বামী সর্বানন্দ অবধূত।
তবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষত রাঢ় বঙ্গের মেদিনীপুর, ২৪ পরগণা, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, হুগলী এবং বর্ধমান অঞ্চলে এখনও যে ধর্মঠাকুরের পুজো হয়, তার মধ্যে কিছু জায়গায় মূর্তি পুজোরও চল রয়েছে। স্বামী সর্বানন্দ অবধূত বলছিলেন, ‘ধর্মঠাকুরের কোনও মূর্তি হয় না। মূর্তি পুজো তো শুরু হয়েছে মাত্র কয়েকশো বছর আগে থেকে। আদিম যুগ থেকে যেভাবে শিলাখণ্ডে ধর্মঠাকুর পূজিত হয়ে আসছেন, আমরা সেভাবেই পুজো করছি।’
ধর্মঠাকুর কি হিন্দু দেবতা?
সনাতন হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে ধর্মতলায় ধর্ম ঠাকুরের পুজো হলেও আদৌ ধর্ম ঠাকুর কি হিন্দু ধর্মের দেবতা? প্রশ্ন আছে এ নিয়েই। তিনি আসলে কোন ধর্মের ঠাকুর, তা নিয়ে টানাপোড়েন রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ আর অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে। পুরাণ গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন বলছেন, ‘একটা সময়ে পুরো বাংলাতে বৌদ্ধ ধর্মই প্রচলিত ছিল। ডোম, বাউরি, তাঁতি, হাঁড়ি, দুলে, বাগদি ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষরা বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তারা বুদ্ধদেব কে ধর্ম নিরঞ্জন হিসাবে পুজো করতেন।’ ‘বল্লাল সেনের আমলে সরাসরি বৌদ্ধদের ওপরে আক্রমণ শুরু হয়। প্রাণের ভয়ে মানুষ পালিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। তাদের উপাস্য ‘ধম্ম’কে একই রেখে বহিরঙ্গের কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। বদলে যায় তাদের জীবনশৈলীও। এ বদলটাই হল ধর্মঠাকুর। ধর্ম নিরঞ্জনের মূর্তিটাও পাল্টিয়ে যায় বিভিন্ন জায়গায়,’ বলছিলেন উদ্দীপন।
ধর্ম ঠাকুরের পুজা অর্চনার রীতি বাঁচিয়ে রাখতে মধ্য যুগে ধর্মমঙ্গল কাব্য রচিত হয়। মঙ্গলকাব্যের তিনটি প্রধান শাখার অন্যতম এই ধর্মমঙ্গল কাব্য। গবেষকরা বলছেন, রাঢ় বাংলার লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য প্রচারই এর মূল উদ্দেশ্য ছিল।
বৌদ্ধ দেবতার হিন্দুকরণের চেষ্টা?
কলকাতার সম্বোধি বুদ্ধ বিহারের পরিচালক ড. অরুণজ্যোতি ভিক্ষু বিবিসিকে বলছেন, ‘ধর্ম পুজো যে বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরই, তার বহু প্রমাণ রাঢ় বাংলায় ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মকে মুছে দেয়ার জন্য নানা পৌরাণিক কাহিনী বানিয়ে তাকে ধীরে ধীরে হিন্দু দেবতায় পরিণত করা হয়েছে।’ তার কথায়, ‘এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে শঙ্করাচার্যের সময় থেকে। বুদ্ধকে শ্রীকৃষ্ণের নবম অবতার রূপে দেখানো হয় তখন থেকেই। কিন্তু ভগবান বুদ্ধ তো একজন মানব সন্তান ছিলেন। এভাবেই দেখানো চেষ্টা হচ্ছে যে বৌদ্ধ ধর্ম আদতে হিন্দু ধর্মেরই অংশ।’ সূত্র: বিবিসি।