উৎসব, আনন্দ আর বিশ্বমানবতার মঙ্গল কামনায় শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) বাংলা বর্ষপঞ্জিুর প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। ছয় শতাব্দীরও বেশি কাল আগে শুরু হওয়া পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালি সঙস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শুক্রবার সকাল সোয়া ৬টায় রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীদের গান ও কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে দিনটিকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে উৎসব শুরু হয়। শতাব্দী-প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে, সর্বস্তরের মানুষ বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ স্বাগত জানাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের জনপ্রিয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে উৎসব উদযাপন করে। একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ বছরের আকাঙ্খায় এই সর্বজনীন উৎসব পালিত হয়।
এটি টানা দ্বিতীয় বছর পহেলা বৈশাখ পালিত মুসলিমদের পবিত্র মাস রমজানে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হন শত শত মানুষ। ঐতিহ্যগতভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ চত্বর থেকে। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রতিফলিত হয় বিশ্ব এবং বাঙালি উভয় ধরনের সাংস্কৃতিক ধারা।
বিশ্ব শান্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গাওয়া গান ‘বরিশ ধারা মাঝে শান্তির বাড়ি’ স্লোগান নিয়ে এবারের শোভাযাত্রায়; ভেড়া, হাতি, নীলগাই, টেপা পুতুল, বাঘ ও ময়ূরের ছয়টি বড় কাঠামো উপস্থাপন করা হয়। যা আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ধারাকে প্রতিফলত করে।
এদিকে, গ্রাম অঞ্চলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঐতিহ্যবাহী নতুন খাতা বই ‘হালখাতা’ খুলে ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। দিনটিতে ছিলো সরকারি ছুটির।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। শোভাযাত্রায় অংশ নেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
উপাচার্য বলেন, “বাংলা নববর্ষ-১৪৩০ আশা ও সাফল্যের বার্তা নিয়ে এসেছ। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এটি ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিলো।”
তিনি বলেন, “শোভাযাত্রা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এখন এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও। এটি এখন বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য মহান সম্পদ। এটি বজায় রাখা, সংরক্ষণ করা এবং সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। এই আয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শনকে প্রতিফলিত করে।”
উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, “এটি সব ধরনের চরমপন্থার বিরুদ্ধে মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক আহ্বান।”
এবারের শোভাযাত্রার প্রধান দুটি মোটিফ হচ্ছে মায়ের কোলে শিশু এবং নীল ষাঁড় (নীলগাই)। মায়ের কোলে শিশু যেমন নিরাপদ, সেখানে প্রতীকীভাবে বিশ্ব শান্তির বার্তা রয়েছে। এ ছাড়া বিপন্ন ও হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছে নীলগাইকে। এ ছাড়া শোভাযাত্রায় আরো চারটি মোটিফ প্রদর্শিত হয়েছে। সেগুলো হলো বাঘ, ময়ূর, ভেড়া ও হরিণ।

বটমূলে ছায়ানট
বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান হলো বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট-এর রমনা বটমূলের সাংস্কৃতিক উৎসব। ঐতিহ্য মতে, সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে রমনা রমনা বটমূল উৎসব শুরু হয়। সারেঙ্গীতে ‘রাগ অহীর ভৈরব’ সুরের আট মিনিটের পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় দিনের অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে মোট ১২টি একক গান, দুটি আবৃত্তি এবং ১০টি কোরাস পরিবেশন করা হয়; যার মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বণিত হয় প্রকৃতি, মানবতার প্রতি ভালোবাসা, আত্মশুদ্ধি ও দেশপ্রেম। রাজধানীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেয় এই আনন্দ উদযাপনে। স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। দলগতভাবে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতি বছর রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অসামান্য সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজনের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। ব্যতিক্রম ছিলো ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়; তারপর ২০২০-২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের কারণে। এ, পবিত্র রমজান মাসে এই অনুষ্ঠানটি দ্বিতীয়বারের মতো উদযাপিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্খিত এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। বাংলা বর্ষ বরণ, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসব।