Thursday, January 16, 2025

সপ্তাহে শীর্ষে

প্রাসঙ্গিক বার্তা

ইসরায়েলি আক্রমণ গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে, বলছে জাতিসংঘ

জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের এক প্রতিবেদনে মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) বলা হয়েছে, গাজার হাসপাতালগুলোর উপর উপর্যুপরি ইসরায়েলি হামলা এবং আশেপাশের এলাকায় সামরিক অভিযান গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

উনিশ পাতার এই রিপোর্ট বলছে, হাসপাতালের উপর এবং কাছাকাছি “ভয়াবহ ইসরায়েলি হামলার প্যাটার্ন”-এর ফলে “গাজার বেশির ভাগ হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে,” যার ফলে অনেক হাসপাতালের আশেপাশে যুদ্ধ চলেছে এবং “স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।”

“দু’হাজার তেইশ সালের অক্টোবরের পর পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই নাজুক অবস্থায় ছিল, তাকে নিশানা করে হামলা চালানো হয়েছে যার ফলে শত শত স্বাস্থ্য কর্মী এবং মেডিকেল পেশাজীবী নিহত হয়েছে,” প্রতিবেদনের লেখকরা বলেন।

এই প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে – যখন হামাস ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ১২০০ জনকে হত্যা এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে – ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়।

হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে।

জাতিসংঘ হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস ফলকার টুক। ফাইল ফটো।

মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন

এই সময়ের মধ্যে, প্রতিবেদনে অন্তত ২৭টি হাসপাতাল এবং ১২টি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কমপক্ষে ১৩৬টি হামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে, এবং স্বাস্থ্য কর্মী আর বেসামরিক মানুষদের মধ্যে বহু হতাহত হবার দাবী করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, হামলার ফলে বেসামরিক অবকাঠামোর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, “যদি না পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে থাকে।”

“এই প্রতিবেদন গাজার স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা ধ্বংস করার বর্ণনা সচিত্র ভাবে তুলে ধরেছে। এসব আক্রমণে আন্তর্জাতিক মানবিক এবং মানবাধিকার আইন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে রোগী, স্বাস্থ্য কর্মী এবং অন্যান্য বেসামরিক মানুষ হত্যার মাত্রা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে,” জাতিসংঘ হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস ফলকার টুক এক বিবৃতিতে বলেন।

তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন মানার ব্যাপারে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়ে যে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে হাসপাতালকে নির্দিষ্টভাবে সুরক্ষা দেয়া আছে। তবে শর্ত থাকে যে, হাসপাতাল “তাদের মানবিক কার্যক্রমের বাইরে এমন কোন কাজ করবে না বা করার জন্য তাদের ব্যবহার করা হবে না, যা শত্রুর জন্য ক্ষতিকর।”

“অবিরাম বোমাবর্ষণ এবং গাজার নাজুক মানবিক পরিস্থিতি যেন যথেষ্ট নয়, এমনকি যে একটি মাত্র আশ্রয়স্থলে ফিলিস্তিনিদের নিরাপদ বোধ করা উচিত, সেটাও এক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে,” টুক বলেন। “যুদ্ধের সময় হাসপাতালের নিরাপত্তা আবশ্যক এবং সেটা সব পক্ষকে, সব সময় মেনে চলতে হবে।”

ইসরায়েলি সৈন্যদের গাজায় মোতায়েনের প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে। ফটোঃ ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪।

ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ইসরায়েল এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। জেনেভায় ইসরায়েলের স্থায়ী প্রতিনিধি ১১ পাতার এক জবাবে অফিস অফ দ্য হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর চতুর্থ “থিম্যাটিক রিপোর্ট”কে “ইসরায়েলের দুর্নাম করতে ওএইচসিএইচআর-এর অন্তর্নিহিত বদ্ধসংস্কারের” আরও একটি উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করে।

তারা অভিযোগ করে যে, জাতিসংঘের এই সংস্থা “স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে হামাসের সামরিক তৎপরতার প্রমাণ” নাকচ করে দেয়। তারা বলে যে সংস্থা “গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হামাস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করার ঘটনা আমলে নিতে অনিচ্ছুক।”

ওএইচসিএইচআর তার প্রতিবেদনে যে পদ্ধতি ব্যবহার করে, সেটাকে ইসরায়েলের স্থায়ী মিশন “সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ” বলে বর্ণনা করে। তারা “নির্ভরযোগ্য সূত্রের” উপর সংস্থার নির্ভরশীলতার সমালোচনা করে, এবং হাসপাতালের উপর আক্রমণকে যুক্তিসংগত বলে অভিহিত করে যেহেতু হাসপাতালগুলো ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করছিলো।

“স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে হামাসের সন্ত্রাসী তৎপরতার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে,” স্থায়ী মিশন বলে। “হামাস তাদের কৌশলের অংশ হিসেবে তাদের সুরঙ্গ নেটওয়ার্ক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের ভেতরে স্থাপন করে এবং সেগুলোকে অস্ত্রের গুদাম এবং কর্মীদের জন্য হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করে।”

ইসরায়েলি আক্রমণের মুখে গাজা সিটির কামাল আদওয়ান হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ফটোঃ ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪।

হাসপাতাল আক্রমণ যুদ্ধাপরাধ

ওএইচসিএইচআর জানাচ্ছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে গাজা সিটির আল-শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে ইসরায়েল যেখানেই স্থল অভিযান চালিয়েছে সেখানেই হাসপাতালের উপর আক্রমণ হয়েছে।

আক্রমণ আজ অব্দি অব্যাহত আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “আক্রমণের যে প্যাটার্নের কথা এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের উপর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ভয়ানক আক্রমণে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে ১৫টি “আংশিক কার্যকরী” রয়েছে, যাদের মধ্যে ৯টি দক্ষিণে আর ৬টি উত্তরে।

প্রতিবেদনের লেখকরা বলছেন, “হাসপাতাল এবং অন্য যেসব জায়গায় অসুস্থ এবং আহত লোকজন চিকিৎসাধীন এবং যেগুলো সামরিক লক্ষ্যবস্তু নয়, সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে হামলা চালানো … এবং সামঞ্জস্যহীন আক্রমণ চালানোও যুদ্ধাপরাধ।”

তারা যোগ করেন, “কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে, ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ধ্বংস করাকে সমষ্টিগত শাস্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে, যা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।”

মানবাধিকার সংস্থার প্রধান টুক এসব ঘটনার স্বাধীন, পূর্ণ এবং স্বচ্ছ তদন্তের এবং “আন্তর্জাতিক মানবিক এবং মানবাধিকার আইনের যত লঙ্ঘন হয়েছে, তার জন্য পূর্ণ জবাবদিহিতার” আহ্বান জানান।

তাঁর আহ্বানের জবাবে জেনেভায় ইসরায়েলের স্থায়ী মিশন বলে, “ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার অঙ্গীকার পুনরায় ব্যক্ত করছে, এবং প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির মাধ্যমে যেকোনো অস্বাভাবিক ঘটনা তদন্ত করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।”

–ভয়েজ অব আমেরিকা

পাঠক প্রিয়