ইউক্রেনে রাশিয়ার তিন বছরব্যাপী যুদ্ধ গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে শান্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নন। অন্যদিকে রবিবার ইউরোপীয় নেতারা লন্ডনে এক শীর্ষ সম্মেলনে কিয়েভের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।
এই নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে শুক্রবার ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেন্সকির মধ্যে উত্তপ্ত বৈঠকের দু’দিন পর। বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতা জেলেন্সকিকে হোয়াইট হাউস ত্যাগ করার আদেশ দেন এবং দু’দেশের মধ্যে রেয়ার আর্থ খনিজ নিয়ে সম্ভাব্য চুক্তি সাক্ষর করা হয়নি।
“আমাদের আমূল রিসেট প্রয়োজন,” যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড পিটার ম্যান্ডেলসন এবিসি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের “দিস উইক” অনুষ্ঠানে বলেন। কোন শান্তি আলোচনার আয়োজন করা হয়নি।
ম্যান্ডেলসনের পর্যালোচনা আসলো যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কির স্টারমার, যুক্তরাষ্ট্র দোদুল্যমান থাকা সত্ত্বেও, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর জন্য সাহায্যের অঙ্গীকার করার লক্ষ্যে লন্ডনে এক ডজনের বেশি ইউরোপীয় নেতার সম্মেলনের আয়োজন করেন।
জেলেন্সকিকে পাশে রেখে এবং ইউক্রেন আর ইউরোপীয় দেশগুলোর পতাকার সামনে বসে স্টারমার বলেন যে, “ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য এই মুহূর্ত প্রতি প্রজন্মে একবার আসে, এবং আমাদের সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।”
স্টারমার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে বলেন, “আমি আশা করি আপনি জানেন যে, আমরা সবাই যত দিন প্রয়োজন তত দিন আপনার এবং ইউক্রেনের জনগণের সাথে আছি, এই টেবিলে বসা সবাই।”
“সবার মঙ্গলের জন্য শক্তির উপর ভিত্তি করে শান্তি অর্জন করার লক্ষে কী করতে হবে সে বিষয়ে আমাদের একমত হতে হবে,” তিনি বলেন।
তবে ট্রাম্প শুক্রবার জেলেন্সকিকে বলেন যে, তিনি তাঁকে হোয়াইট হাউসে পুনরায় স্বাগত জানাবেন শুধুমাত্র তখন, “যখন তিনি শান্তির জন্য প্রস্তুত।”
ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজ সিএনএন টেলিভিশন নেটওয়ার্কের “স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন” অনুষ্ঠানে জেলেন্সকি সম্পর্কে বলেন, “আমাদের কাছে যেটা পরিষ্কার ছিল না, তা হলো, তিনি এই যুদ্ধ শেষ করতে আমাদের লক্ষের সাথে একমত কিনা। এটা পরিষ্কার ছিল না যে তিনি শান্তির জন্য প্রস্তুত।”
ওয়াল্টজ বলেন রাশিয়া এবং ইউক্রেনকে এক সময় আলোচনার মাধ্যমে আপোষ করে শান্তি চুক্তি করতে হবে। “এটা করতে গিয়ে অনেক ধরনের পুরস্কার আর শাস্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে হবে,” তিনি বলেন।
মার্ক রুবিওঃ ‘আমরা যুদ্ধ শেষ করতে চাই’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দু’পক্ষের আলোচনার টেবিলে আসার উপর জোর দেন।
“আমরা একটা যুদ্ধ শেষ করতে চাচ্ছি,” রুবিও বলেন। “দু’পক্ষই টেবিলে না আসলে আপনি যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন না। শুরু হবে রাশিয়া দিয়ে। এবং এই কথাটিই প্রেসিডেন্ট বলেছেন। তাদেরকে টেবিলে আনার জন্য আমাদের যা কিছু করা প্রয়োজন তাই করতে হবে, এটা আদৌ সম্ভব কি না, তা দেখার জন্য।”
“আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি না যে এটা সম্ভব,” রুবিও যোগ করেন। “আমি আপনাকে বলছিনা যে এটা ৯০ শতাংশ সম্ভব। আমি বলছি আমরা যদি তাদের আলোচনার টেবিলে না আনতে পারি তাহলে সেটার সম্ভাবনা শূন্য শতাংশ। যত শীঘ্রই মানুষ বুঝতে পারবে যে এই যুদ্ধ একটি খারাপ পরিণতির দিকে যাচ্ছে, চতুর্দিকে মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ এবং যার আশে-পাশে নানা রকমের বিপদ যেগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ব্যাপক সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে, যত শীঘ্রই মানুষের এই উপলব্ধি হবে, তখন আমার মনে হয় আমরা অগ্রগতি অর্জন করতে পারবো।”
স্টারমার বলেন ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইউক্রেন একটি যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পেশ করা হবে।
কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ বলেছে তারা যুদ্ধবিরতি রক্ষার জন্য ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে ইচ্ছুক। কিন্তু তারা বলছে রাশিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সমর্থন প্রয়োজন, যদি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবার পর তা ভঙ্গ করেন বা নতুন আগ্রাসন চালান।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাঠানোর কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন, এবং বলেছেন তিনি বিশ্বাস করেন যে পুতিন যুদ্ধ বন্ধ করার শর্তগুলোতে রাজী হবার পর তাঁর কথা রাখবেন
এই সম্মেলনকে ম্লান করেছে শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্ককিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নজিরবিহীন ভর্ৎসনার ঘটনা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন, রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করছেন জেলেন্সকি।
তবে স্টারমার বলছেন, তিনি শান্তি আলোচনা আবারও শুরু করার উদ্দেশ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনে নজর দিচ্ছেন এবং (ওই দুই পক্ষের) আলোচনা ভেস্তে গেলেও তিনি “স্রোতে গা না ভাসিয়ে” এই অবসরে ট্রাম্প, জেলেন্সকি ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাক্রোর সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে চান।
“আমরা একমত হয়েছি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং আরও এক বা দুইটি দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে কাজ করে যুদ্ধ বন্ধের একটি পরিকল্পনা তৈরি করবে এবং তারপর আমরা সেই পরিকল্পনাটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করব”, বিবিসিকে বলেন স্টারমার। স্টারমার ও ম্যাক্রো উভয়ই শুক্রবারের (ঘটনার) পর ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেছেন।
রবিবারের বৈঠক এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
লন্ডনের বৈঠকটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মিত্র ইউক্রেনকে সুরক্ষা দেওয়া এবং ইউরোপ মহাদেশের প্রতিরক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর আলোকে আরও বড় আকারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রবিবারের সম্মেলনে সম্ভবত একটি ইউরোপীয় সামরিক বাহিনী গঠন করে ইউক্রেনে মোতায়েন করে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। স্টারমার বলছেন, “যারা ইচ্ছুক ,তারা এই জোটবদ্ধ উদ্যোগে অংশ নেবেন”।
স্টারমার বলছেন, তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিশ্বাস করেন না কিন্তু ট্রাম্পকে করেন।
“ডনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেন তিনি দীর্ঘমেয়াদী শান্তি চান, তখন কি আমি তা বিশ্বাস করি? উত্তর হলো, হ্যাঁ”, বলেন তিনি।
স্টারমার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য “নিবিড় আলোচনা” চলছে, যা দীর্ঘমেয়াদী শান্তির তিন উপকরণের একটি।
“যদি চুক্তি হতে হয়, যদি যুদ্ধ বন্ধ হতে হয়, তাহলে সেই চুক্তিকে সুরক্ষা দিতে হবে, কারণ সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির উদ্রেক তখনই হবে যখন যুদ্ধে একটি সাময়িক বিরতি আসবে এবং তারপর (রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির) পুতিন আবারও (হামলা করতে) আসবেন”, বলেন স্টারমার। “অতীতেও এরকম হয়েছে, আমি মনে করি এটা প্রকৃত হুমকি, এবং এ কারণেই আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে যদি চুক্তি হয়, তাহলে সেটা যেন টেকসই চুক্তি হয়, সাময়িক বিরতি নয়।”
লন্ডন সম্মেলনে ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, স্পেন, কানাডা, ফিনল্যান্ড, সুইডেন এবং চেক প্রজাতন্ত্রের নেতারা যোগ দিয়েছেন।
এই রিপোর্টের কিছু তথ্য দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এবং এএফপি থেকে নেয়া হয়েছে।