Skip to content

আলঙ্কারিক পদে ‘পিছলে-বর্গ’, ক্ষমতায় ‘এলিট-বর্গ’ – TheWall

আলঙ্কারিক পদে ‘পিছলে-বর্গ’, ক্ষমতায় ‘এলিট-বর্গ’ – TheWall


ড: প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়

ভারতীয় রাজনীতিতে খুব শোরগোল হচ্ছে। একদিকে নতুন সংসদ ভবন উদ্ঘাটনে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা সংসদের স্পিকারকে পিছনে ফেলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সে দ্বায়িত্ব নিলেন, আবার অন্যদিকে কষ্টার্জিত পদক জলে ফেলে দিচ্ছেন দেশের বিশ্বমানের ক্রীড়ায় পদকজয়ী কুস্তিগিররা। ভারতবর্ষে গণতন্ত্র ভ্যানিশ বলে অনেকেই বলছেন। একটু ঠান্ডা মাথায় সাম্প্রতিক জাতীয় রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, গণতন্ত্র, সংবিধান, সংসদ, রাজনীতিবিদ যে যেখানে আছেন ভালই আছেন। এবং এক নতুন খেলায় মেতেছেন সবাই। সেই খেলার কথা বহুকাল আগেই দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেছিলেন – ক্ষমতাধিকারী ও ক্ষমতাঅনাধিকারী। কয়েক মাস আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবারও অনগ্রসর শ্রেণি বা ‘পিছলে-বর্গ’ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রার্থী দিয়েছিল। আগেরবার রামনাথ কোবিন্দ আর এবার দ্রৌপদী মুর্মু। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাদের প্রার্থীর (জগদীপ ধনকড়) আইনজ্ঞ সত্ত্বার বাইরে তাঁর কৃষক পরিবারের সদস্য সত্ত্বা বেশি আলোচনায় এনেছে ভারতীয় জনতা পার্টি। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে আসল শিবসৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন একনাথ শিন্ডে। শিবসেনার স্থপতি বালাসাহেব ঠাকরের উত্তরসূরী তাঁর পরিবারের উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বকে বা পরিবারতন্ত্রকে অস্তাচলে পাঠিয়ে। নিচুতলার মানুষের ভারতীয় রাজনীতিতে উঠে আসার গল্প বলছেন অনেকে। কিন্তু একটু ভাবুন তো, দ্রৌপদী মুর্মু বা রামনাথ কোবিন্দ— এঁরা তো ভারতীয় জনতা পার্টির কর্মী থেকে নেতা হয়েছেন। সরাসরি ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। কিন্তু এঁদের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আনা হয়নি কেন? কেন প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঠাঁই হয়নি?

আবার একনাথ শিন্ডে (যিনি প্রাথমিক ভাবে ছিলেন অটো-চালক এবং পরে শিবসেনার মাধ্যামে ক্ষমতার অলিন্দে এসেছেন) শিবসেনার মধ্যে বিভাজন তৈরি করে নতুন নেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেন। কিন্তু তিনি শিখন্ডি হিসেবে থাকলেন। আসল নিয়ন্ত্রকের জায়গায় থাকলেন উপমুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। আসলে এটাই ভারতীয় রাজনীতির নতুন খেলা – পিছলে-বর্গকে আলোর আঙিনায়, গণমাধ্যমের পর্দায় বিশাল রাজনৈতিক অবয়ব তৈরি করতে নিয়ে আসা। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের পদ আলঙ্কারিক। আসল ক্ষমতার পদে থাকছেন এলিট- বর্গের লোকজনই। তাই এই সূক্ষ্ম খেলাটা অনুধাবন করার তাগিদ থেকে নতুন খেলার পরিসর তৈরি প্রয়োজন। যেখানে ক্ষমতার পদে থাকবেন অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধিরা। তবেই তো ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ পালনের স্বার্থকতা!

স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় রাজনীতি জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। এবং সেখানে পরিবারতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করেছিল। উনবিংশ শতকে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উপনিবেশ তৈরি করছে, তখন একটি যুক্তি ছিল, ‘সাদা চামড়ার মানুষদের কষ্টসাধ্য হলেও একটি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ব হল, উপনিবেশগুলিকে তাদের নির্দেশিত প্রগতি ও আধুনিকতার রাস্তায় নিয়ে চলা’ (white man’s burden)। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে মহাত্মা গান্ধী ও বাবাসাহেব আম্বেদকারের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয় (১৯৩২) অন্তজ বা অস্পৃশ্য বা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলির জন্য আলাদা নির্বাচনী কেন্দ্র তৈরি করা নিয়ে। স্বাধীনতা উত্তর পরিস্থিতে জাতীয় কংগ্রেস বেশ অনেকটা সময়কাল ধরে (১৯৪৭-৭৭) নিজেদের উপর দায়িত্ব স্বআরোপিত করে নেয় পিছিয়ে পড়া জনসমষ্টিকে একটি নির্দষ্ট পথে (পরিকল্পিত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত) উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার, যদিও ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগান দিতে তারা বাধ্য হয় ‘পিছলে-বর্গ’দের এটা বোঝানোর জন্য। পরিবারতন্ত্রের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্য স্তরের নেতারা হয়ে উঠেছিলেন দলের মধ্যে ‘পিছলে-বর্গ’ এবং তাঁরা বিভাজন তৈরি করে কংগ্রেস (সংগঠন) ও কংগ্রেস (ইন্দিরা) এইভাবে।

১৯৭৭ থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে পিছলে-বর্গের প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায় বিত্তশালী কৃষকদের (বুলক কার্ট ক্যাপিটালিস্ট) এবং ১৯৮৯ সালের মণ্ডল-কুমণ্ডল সংরক্ষণের রাজনীতি ও ১৯৯২ সালে বারবি মসজিদ কাণ্ডের পর থেকে পিছলে-বর্গের অস্তিত্ব নির্বাচনী ভোট-ব্যাঙ্কের সঙ্গে সমার্থক হয়ে ওঠে। কখনও সংরক্ষণ, কখনও ধর্মীয় মেরুকরণ আবার কখনও জোট রাজনীতির জন্য। নয়ের দশকে কংগ্রেস ঘরানার সরকারের আমলে কেআর নারায়াণান ষ্ট্রপতি হয়েছিলেন ‘পিছলে-বর্গ’ থেকেই। আসলে ছয় বা সাতের দশকে স্বআরোপিত দায়িত্ব সমালোচনা শুরু হওয়ায় নয়ের দশকে ভারতীয় রাজনীতি ‘পিছলে-বর্গ’কে সম্মান ও সম্ভ্রম প্রদান করতে থাকে নির্বাচনী আঁতাতের মাধ্যমে বা বিভিন্ন জনকল্যাণকারী প্রকল্পের মাধ্যমে বা আলঙ্কারিক পদ প্রদানের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে মীরা কুমারের লোকসভা অধ্যক্ষের পদে আসীন হওয়া সেই খেলারই এক দৃষ্টান্ত।

২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসে কেন্দ্রে। ২০১৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসে আরও বিস্তৃত জনাদেশ নিয়ে | ভারতীয় জনতা পার্টি কংগ্রেস মুক্ত ভারত বা কংগ্রেসের সমস্ত ব্যবহারিক ও নীতিগত পথ বর্জন করে নতুন ভারত বা আত্মনির্ভর ভারতের পথ অনুসন্ধান করতে উদ্যত হয়। কিন্তু পিছলে-বর্গের অবস্থান কোথাও যেন এক হয়েই থাকে। ভারতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কেনও হবেন না রামনাথ কোবিন্দ বা দ্রৌপদী মুর্মু? আলঙ্কারিক পদেই তাঁদের ক্ষমতায়ন? রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপাল—এই দুটি পদ সংবিধান অনুযায়ী আলঙ্কারিক। যাঁরা রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে চলে। ভারতবর্ষে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রেট ব্রিটেনের রাজা-রানির পদের মতোই আলঙ্কারিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদের মতো ক্ষমতায় বলিয়ান পদ নয়। নীতি পঙ্গুতার কারণে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি ভারতবাসীর মোহভঙ্গ হয় এবং ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আছে এখন। কিন্তু সরকারি প্রকল্প, স্বাস্থ্য বিমা, বিজলি, পানি, সড়ক, এগুলো জনসাধারণের জন্য আর সেখানে শুধুমাত্র পিছলে বর্গের জন্য কিছু করলেও সেটা তো ক্ষমতায়ন নয় সেটা হল কল্যাণসাধন।

তাহলে বদল কোথায় হল? আসলে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে কোনো বদল আসেনি। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ‘এলিট-বর্গ’ আছে। মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক সি রাইট মিলস ১৯৫৬ সালে ‘সামরিক-শিল্পপ্রতিষ্ঠান’ এলিট তত্বের অবতারণা করেছিলেন। আজ ২০২৩-এর ভারতে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে কর্পোরেট-রাজনীতিবিদ এলিট-বর্গ, যেখানে রাজনীতিবিদ মানেই এলিট নয়। সেই রাজনীতিবিদ এলিট যাঁর কর্পোরেট উপস্থিতি আছে| নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডা মোহন ভাগবত দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, নিদেনপক্ষে বাবা রামদেবও এলিট-বর্গ। কিন্তু একনাথ শিন্ডে বা দ্রৌপদী মুর্মুরা ভারতীয় রাজনীতির দাবা খেলায় ঘুঁটি হয়েই সন্তুষ্ট থাকেন।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো মেধা ও সক্ষমতার ভিত্তিতে একটি দেশের নাগরিকদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে থাকার নিদান দিয়েছিলেন। বাংলা ছবি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিতে একটি কবিগানে বলা আছে ‘জন্ম যেমন যার, কর্ম তেমন তার।’ অর্থাৎ যে যেই কাজের উপযুক্ত তাকে সেই কাজেই রাখা হোক। সেটা বংশপরম্পরাভিত্তিক কোনও কাজ হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে এই ধরনের কথা বললেই বৈষম্যের দোষে দোষী করা হবে। কিন্তু মৌখিক ভাষণে নাই বা বললাম, কাজে করে দেখাতে দোষ কোথায়? দলিতদের, আদিবাসীদের বা সমগ্র পিছলে-বর্গের ক্ষমতায়ন বা উন্নয়ন তখনই সম্ভব হবে যখন তারা নীতি-নির্ধারক মণ্ডলীতে থাকবেন ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলের সংগঠনে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ২০২২-এ এসে তাদের কর্মসমিতিতে প্রথম অন্তর্ভুক্তত করেছে পিছলে-বর্গের প্রতিনিধি হিসাবে রামচন্দ্র ডোমকে। কমিউনিস্ট পার্টির এই অবস্থা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, পিছলে-বর্গের প্রতিনিধিদের একটা নির্দিষ্ট স্থান বা স্তর অবধি আসতে দিলেও রাজনীতির সর্বোচ্চ শিখরে তাঁদের উপস্থিতি কোনও দলেই দেখা যাচ্ছে না। এটাকে জেন্ডার স্টাডিজে স্ফটিকের স্তর (glass ceiling) বলা হয় যার ওপরে মহিলাদের যেতে দেওয়া হয়না। ভারতে মহিলারা সেই স্তর ভেঙে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে রাজ্যপাল সব রকম পদে (আলংকারিক ও ক্ষমতালোব্ধ) আসীন হয়ে। এবার পালা পিছলে-বর্গের ভারতীয় রাজনীতির এই সূক্ষ্ম খেলায় ইতি টানার।

সেই নতুন খেলার পরিসর তৈরি করতে হলে প্রথমেই পিছলে-বর্গের প্রতিনিধিদের সজাগ থাকতে হবে কেন, কী অভিসন্ধিতে তাঁদের আলংকারিক পদে আসীন করানো হচ্ছে কোনও ক্ষমতালোব্ধ পদে না রেখে? ভারতের পৌর সমাজ ও সমগ্র নির্বাচক মণ্ডলীকে দাবি তুলতে হবে, প্রধানমন্ত্রী পদে বা দলীয় পদে পিছলে-বর্গের প্রতিনিধিদের স্থান দেওয়া হোক। স্বাধীনতার শততম বর্ষের মাঝে আছে আরও ২৫টি বছর। এই সময়ের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ না হয় অনগ্রসর শ্রেণিকে দিয়েই লেখানো হোক। মীরাবাইয়ের সুরেই না হয় ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্থান হামারা’ গাইলাম আমরা।

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।



বার্তা সূত্র