মূলধারার একজন নারীর এগিয়ে আসার পথে যে প্রতিকূলতা সেটা সামাজিক সমস্যা, অন্যদিকে আদিবাসী নারীর প্রতিকূলতা রাষ্ট্রীয় ও পরিচয়বাদী রাজনীতির সমস্যা। তাই আদিবাসী নারীর ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ক্ষমতায়ন মানে কেবল চাকরি করা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করা নয়। ক্ষমতায়ন মানে অবাধ চলাচল, সামাজিক সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা, আইনি সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার, মজুরির সমানাধিকার, নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার, সম্পত্তির ওপর অধিকার। এক্ষেত্রে, বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার গল্পে আদিবাসী নারীর গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়োজন উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, সকল আদিবাসী নারীর অবস্থান সমান জায়গায় নয়। কেউ সুবিধাপ্রাপ্ত, কেউ প্রান্তিক, কেউ অধিকতর প্রান্তিক। আদিবাসীদের মধ্যে বৃহত্তর জাতি হিসাবে একজন চাকমা নারীর যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে, পাহাড়ের সবচেয়ে প্রান্তিক জাতি চাক নারীর সেই সুযোগ সুবিধা নেই। চাক নারী শিক্ষায়, সম্পদে, সুযোগে আরও পিছিয়ে রয়েছে। তাই মূলধারার নারীদের ক্ষমতায়নের সঙ্গে আদিবাসী নারীকে যুক্ত করতে হলে এসব ভিন্ন ভিন্ন বর্গের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতাকে আমলে নিয়েই কাজ করতে হবে।
সমাজের উঁচুতলার সুযোগ সুবিধের মধ্যে বেড়ে ওঠা উচ্চশিক্ষিত নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার যতটা সহজ হয়, এর নিচে থাকা নারীদের জন্য ততটা নয়। তাহলে কীভাবে, কাদেরকে, কোন ধরনের ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তার জন্য দরকার বিশেষ নীতি, আইন ও তার বাস্তবায়ন। নাহলে কেবল পিরামিড লিডারশিপ তৈরি হয়, যা প্রকৃতপক্ষে পুরুষতান্ত্রিক একটি প্রক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়। নারীবাদ এখন ইন্টারসেকশনালিটির কথা বলে, সমাজে যে বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষ আছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন চিত্রকে তুলে ধরার কথা বলে। এখন নারীবাদ বলে বৈচিত্র্য কেবল নারী আর পুরুষে নয়, বৈচিত্র আছে জাতি, ধর্ম, জেন্ডারসহ আরও নানান সূত্রে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় নারীবাদে কি এসব আছে? নাকি তা আসলে শেষ পর্যন্ত কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষিত মূলধারার বাঙালি নারীর ক্ষমতায়ন? আজকাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনার এক প্রকার চাপ থাকে। এর সঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি ও শর্ত থাকে। কিন্তু তা করতে গিয়ে শুধু এক-দুইজন আদিবাসীকে প্রতিষ্ঠানে সাজিয়ে রাখার মতো করে রাখা হচ্ছে না তো? অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ (meaningful participation) বলে একটি শব্দবন্ধ আছে যা নিশ্চিত করতে গেলে কর্মক্ষেত্রে আদিবাসী নারীর প্রবেশাধিকার নিয়ে কাজ করতে হবে আলাদাভাবে। শুধু যে রাষ্ট্রই এই কাজ করবে তা নয়, এর জন্য দরকার সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানসহ আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক নানান সংলাপের— যার মধ্য দিয়ে সমাজে আদিবাসী সম্পর্কে জ্ঞাননির্মাণ, গঠনমূলক আলোচনা ও পারস্পরিক শিক্ষার লেনদেন হতে পারে। তবেই বাংলাদেশে নারী দিবসের নারীর ক্ষমতায়নের গল্প পূর্ণতা পাবে।