Skip to content

আদিবাসী জীবনকথা: চুনিয়া গ্রামের জনিক নকরেক

আদিবাসী জীবনকথা: চুনিয়া গ্রামের জনিক নকরেক

জনিকের জন্ম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে। বাবার নাম অতীন্দ্র মৃ আর মা অনছি নকরেক। মধুপুর বনাঞ্চলের পীরগাছায় ছিল তার নানার বাড়ি। সেই সূত্রেই ত্রিপুরা থেকে মধুপুরে আসেন তারা। পরে স্থানীয় অনীতা মৃ-কে বিয়ে করেন জনিক। পরে আর ত্রিপুরায় ফিরে যাননি।

জনিক আদি গারোদের মতোই পূজা-পার্বণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন। পরিবারের সবাই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হলেও নিজের মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি তিনি। এই প্রকৃতি-পূজারী বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন। তবুও পূর্বপুরুষদের জাতিসত্তা রক্ষায় এখনও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করছেন। ফলে মান্দি বা গারো  জনগোষ্ঠীর কাছে এক জীবন্ত কিংবদন্তি জনিক নকরেক।

জনিক না থাকলে কি সাংসারেক ধর্মটা আর থাকবে না? এমন প্রশ্নে পরাগ রিছিল মুচকি হাসেন। তারপর আশা নিয়ে বলেন, ‘বিলুপ্ত হবে না সাংসারেকরা। কোনো পাখি-প্রাণীর প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শুনলে যাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়, আমিও তো তাদেরই দলে। প্রবল ঝড়ের কবলে পড়া মানুষ যেমন বিরুদ্ধ বাতাসে, ঝড়-বাতাসে সামনে এগোতে থাকে, উঠে দাঁড়াতে চায়- সাংসারেক মন, সাংসারেক জীবন ঠিক তেমনি।’

পরাগ নিজেই সেই বিরুদ্ধ বাতাসে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তিন পুরুষ ধরে খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান পরাগ রিছিল এখন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে একজন সাংসারেক বলে ঘোষণা করেন। তার দাবি, শৈশবে অজান্তেই তাকে বাপ্তাইজ করা হয়েছিল, তিনি কখনও খ্রিস্টান হননি।

লালমাটির পথ পেরিয়ে একেবারে শেষপ্রান্তে বড় একটি ঘর। মাটির দেওয়ালের ওপরটায় টিন। ঘরের বারান্দায় কাঠের চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে সামনে মাঠের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলেন জনিক নকরেক। আমাদের পায়ের শব্দে তার খেয়াল ফিরে। কেমন আছেন? জানতে চাইলেই উত্তরে মিলল হাসিমুখ।

জনিককে দেখে অন্যরকম লাগছিল। তার ভাঁজখাওয়া চামড়ার পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। নিজ জাতির মানুষদের ধর্মান্তরিত হতে দেখেছেন। কিন্তু তবুও দৃঢ়ভাবে তিনি টিকেয়ে রেখেছেন মান্দিদের আদি সাংসারেক ধর্মটিকে। সংগ্রামী এই মানুষটির দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকিয়ে থাকি খানিকক্ষণ।

আমাদের প্রজন্ম আদিবা ও মুরসালীন আবদুল্লাহ মেঘও গিয়েছিল সঙ্গে। জনিক নকরেকের মতো মানুষকে দেখাবো বলেই নিয়ে এসেছি ওদের। ওরাও জনিকের পাশে বসে আলাপ জমায়। তিনিও বেশ হাস্যোজ্জ্বল। থেমে থেমে বলছেন নানা কথা। কিছু কথা বুঝছি আর বাকিটা বুঝিয়ে দিচ্ছে পূর্ণিমা। হঠাৎ কী এক খেয়ালে জনিক তার হাতটি বাড়িয়ে দেয় আদিবা ও মেঘের দিকে। তারাও তার হাতটি স্পর্শ করে আনন্দ নিয়ে। এ যেন দুই প্রজন্মের অন্যরকম কোনো এক প্রতিশ্রুতির আলিঙ্গন।

পাশে বসে কথা চলে জনিকের সঙ্গে। বয়সের ভারে নুব্জ্য তিনি। স্মৃতিও লোপ পেয়েছে। কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় খেইও হারিয়ে ফেলেন। তবুও স্মৃতি হাতড়ে বলেন নানা কথা। বাল্যকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গল্প শুনেছেন জনিক। যৌবনে ব্রিটিশ শাসনের দাপটও দেখেছেন। ভারত বিভক্তির সময় ‘হাতমে বিড়ি মুখমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান শুনেছেন। মধুপুর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা হেঁটে ময়মনসিংহ গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মহাত্মা গান্ধীর জনসভায়। সেসব স্মৃতির এখনও মনে পড়ে তার।

১৯৫০ সালের কথা। প্রজাস্বত্ব আইনে জোর করে মধুপুরে জুম আবাদ নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে প্রতিষ্ঠিত সচ্ছল মান্দি বা গারোরা প্রায় পথে বসে যায়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার মান্দিদের হাজার বছরের ‘বলসাল ব্রিং’ এর নাম পাল্টে ফেলে। বনের ভেতর সব মান্দি গ্রামসমেত প্রাচীন এই বনভূমির নাম করা হয় ‘জাতীয় উদ্যান’। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পরেশ চন্দ্র মৃ ও জনিক নকরেকদের নেতৃত্বে গর্জে ওঠে পুরো চুনিয়া গ্রাম। পরবর্তীতে ‘জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের’ মাধ্যমে মধুপুর বন রক্ষার লড়াই আরও দৃঢ় হয়।

১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা বাংলোতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা ও সাক্ষাত হয়েছিল জনিক নকরেকের। সেটিই তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি বলে মনে করেন তিনি। মধুপুর গড়াঞ্চলের অরণখোলা মৌজায় দুটি খালের মিলনস্থলই ‘দোখলা’ হিসেবে পরিচিত।

বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের চারণভূমি এ এলাকাটি। মধুপুরের পীরগাছা ও থানার বাইদ এলাকা থেকে পৃথক দুটি খাল অরণখোলা মৌজায় এসে একীভূত হয়েছে। কালক্রমে যা ‘দোখলা’ এলাকা নামে পরিচিতি পায়। বিশিষ্টজনদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ ও বিশ্রামের জন্য দোখলায় বনবিভাগ একটি রেঞ্জ ও বিট অফিসারের দুটি কার্যালয় এবং ১৯৬২ সালে দোখলা রেস্ট হাউজ স্থাপন করে।

বার্তা সূত্র