শিল্পী হায়দার হোসেনের একটি গান এখনো মানুষের মুখে মুখে। তিনি লিখিয়াছেন, ‘কী দেখার কথা কী দেখছি।/ কী শোনার কথা কী শুনছি।/ কী ভাবার কথা কী ভাবছি।/ কী বলার কথা কী বলছি।/ ৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।’ এই অমর গান রচনার পর আরও ২১ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে; কিন্তু ইহা আজও প্রাসঙ্গিক। এই প্রশ্ন যাহাতে আর না উঠে, এই জন্য যাহা যাহা করা দরকার তাহা কি আমরা করিতে পারিয়াছি? পদ্মা সেতু উদ্বোধন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, রাস্তাঘাট, কালভার্ট-ব্রিজ তৈরি, ফ্লাইওভারসহ কত কী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করিয়াছি আমরা। নিশ্চয়ই ইহার গুরুত্ব রহিয়াছে; কিন্তু তাহার পরও কি মানুষের মুক্তি আসিয়াছে? স্বাধীনতা লাভের পাঁচ দশক পরেও মানুষ আসলে কী পাইয়াছে? অনেকেই বলিতে পারেন, গৃহহীন মানুষ সরকারিভাবে ঘর পাইয়াছেন, জমি পাইয়াছেন। নিরন্ন মানুষ কম মূল্যে চাউল পাইতেছেন। টিআর, কাবিখা, টাবিখা ইত্যাদি কর্মসূচি হইতে উপকৃত হইতেছেন। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় অনেকে উপকার লাভ করিতেছেন। স্বাধীনতা লাভের পর কোটিপতির সংখ্যা বাড়িয়াছে। ঘরবাড়ি, গাড়ি, নানা অবকাঠামোগত ও অন্যান্য উপায়ে আমরা অনেক, এমনকি ঈর্ষণীয় উন্নতিও করিয়াছি। তাই বলা যায়, আমরা স্বাধীনতা লাভ করিয়া কিছু না কিছু পাইয়াছি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা কি আসিয়াছে?
স্বাধীনতা বলিতে আসলে কী বুঝায়? তাহার পূর্বে বলিয়া রাখি, আমরা যাহা পাইয়াছি তাহা কতটা পাইয়াছি? তাহার মধ্যেও কি শুভঙ্করের ফাঁকি নাই? এখনো বাজারে গেলে কি আমাদের নাভিশ্বাস উঠে না? যতই বলি বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে লন্ডনের মানুষও এক বেলা না খাইয়া থাকে, আমেরিকায়ও মূল্যস্ফীতি চড়া, তাহাতেও কি আমরা বাস্তবতা আড়াল করিতে পারিব? আমাদের কলকারখানাগুলি কি যথারীতি চলিতেছে? নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাইতেছে? তরুণ বেকারদের কি কর্মসংস্থান নিশ্চিত হইয়াছে? মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার আমরা কতটা পূরণ করিতে পারিয়াছি? ‘এ গ্রামার অব পলিটিকস’ গ্রন্থের বিখ্যাত লেখক, রাজনৈতিক দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ হ্যারল্ড জে লাসকির (১৮৯৩-১৯৫০) মতে, ‘লিবারটি ইজ দ্য প্রডাক্ট অব রাইটস’। স্বাধীনতা হইল মানব অধিকারেরই ফল। কেননা অধিকার হইতেই স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিমানুষের অন্তর্নিহিত সত্তার বৈচিত্র্যপূর্ণ বিকাশের জন্য এই অধিকার আবশ্যক; কিন্তু কোনো দেশে যদি ফ্রিডম অব স্পিচ বা বাকস্বাধীনতা না থাকে, মানুষ নির্ভয়ে কথা বলিতে না পারে, মুক্তভাবে চিন্তা করিতে না পারে, তাহা হইলে সেই স্বাধীনতার কি কানাকড়ি মূল্য আছে? ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার, ভোটের অধিকার, ধর্মীয় অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার ইত্যাদির ওপর আঘাত আসিলেই রাষ্ট্রের উচিত তাহা প্রতিরোধ করা; কিন্তু কোনো পুলিশি রাষ্ট্রে নাগরিকদের স্বাধীনতার গ্যারান্টির আশা করা বৃথা। কালো আইনের অস্তিত্ব মানে মানুষের হাতে-পায়ে শিকল পরাইবার নামান্তর। মানুষ যদি নির্ভয়ে ঘুমাইতেই না পারে, তাহা হইলে কীসের অধিকার, কীসের স্বাধীনতা?
বলা হয়, ‘ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি অ্যান্ড এভরিহোয়্যার হি ইজ ইন চেইনস’। দার্শনিক জে জ্যাঁক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) এই চেইন ভাঙিবার উপায়ও বাতলাইয়া দিয়াছেন। আইনি কাঠামোর মধ্য দিয়াই সকল নাগরিকের স্বাধীনতা সংরক্ষণ করিতে হইবে; কিন্তু এমন সকল আইন করা যাইবে না যাহাতে মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। মানুষের জানমাল সবচাইতে মূল্যবান। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হইল আইনের মাধ্যমে ব্যক্তি অধিকারের অনুশীলনকে সুনিশ্চিত করা। অন্যের অসুবিধা বা অসম্মান না ঘটাইয়া নিজের মতো করিয়া বাঁচিয়া থাকিবার নাম যদি স্বাধীনতা হয়, তাহা হইলে এই স্বাধীনতা আমরা কতটা লাভ করিয়াছি? আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধারা যেই সকল অধিকারের স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, তাহার বাস্তবায়নই আমরা কতটা করিতে পারিয়াছি? আজ তাই সকলকে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়া পাইতে হইবে : ‘আজ নেই বর্গী, নেই ইংরেজ, নেই পাকিস্তানি হানাদার—/ আজ তবু কেন আমার মনে শূন্যতা আর হাহাকার!/ আজ তবে কি লাখ শহিদের রক্ত যাবে বৃথা?/ আজ তবে কি ভুলতে বসেছি স্বাধীনতার ইতিকথা।’