প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছে এবং কয়েকটি পত্রিকার ফেসবুক কর্নারে স্ট্যাটাসটি প্রকাশ করেছে। হুবহু তার স্ট্যাটাসটি এমন—‘ড. ইউনূস কেন সাভার স্মৃতিসৌধে যান না। কেন তিনি শহীদ মিনারে যান না। কেন তাকে পহেলা বৈশাখ স্পর্শ করে না; কেন তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেন না; কেন তিনি ১৫ আগস্ট বাঙালির সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে যান না; কেন তিনি ১৬ ডিসেম্বর এবং ৭ মার্চ ধারণ করেন না; ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গিরা যখন সারা দেশে বোমাবাজি করল, কেন তিনি তখন কিছুই বললেন না; ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যখন শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো, তখনো তিনি কেন কিছুই বললেন না; কেন তিনি এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন না (তিনি তো শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত বাঙালি মানুষ)। হতে পারে আমরা আবেগী—অতি আবেগী, আর তিনি….আমি না, বুঝি না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়—সে কারণে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারের বিষয় প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে। স্ট্যাটাসটি মূলত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে। আপনি যে দলের বা মতের হোন না কেন, এমন কাউকে খুঁজে পাবেন না যিনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শহীদ মিনারে বা জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার জন্য যায় না অর্থাৎ প্রত্যেকেই যাওয়ার চেষ্টা করেন। সে জায়গায় বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলবিদ হয়েও দেশের প্রতি মমত্ববোধের উদাহরণ তেমন একটা দেখা যায়নি। করোনাকালীন ড. ইউনূসের কোনো ভূমিকা দেশে দেখা যায়নি। দেশের সংকটে ড. ইউনূসকে কোথাও পাওয়া যায় না। এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে দেশে, তার কোনো সুহৃদ বা বন্ধু নেই। তার বিষয়ে বিদেশিদের আগ্রহ রয়েছে কিংবা তার বিদেশি বন্ধু রয়েছে। সে কারণেই ড. ইউনূসের বিদেশপ্রীতি অনেক এবং তিনি তার কাজের মাধ্যমে তাই প্রমাণ করে চলছেন।
গায়ে মানে না আপনি মোড়ল—এ প্রবাদ বাক্যটির ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে অনলাইনে, বিশেষ করে ড. ইউনূসের বিচারকাজ বন্ধে বিদেশিদের বিবৃতি প্রদানের পর থেকে। সত্যিকারের পথচলা থাকলে এ দেশেও একটি সম্মানের জায়গা তৈরি হতো। দেশের মানুষের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকলে দেশের মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ প্রত্যাহারের সঙ্গে ড. ইউনূসের নাম জড়িয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি মর্মে কানাডার আদালত রায় দিলে সবার দৃষ্টিগোচর হয় বিষয়টি নিয়ে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হলে দেশের তরে অবদান রাখার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন, উল্টো বিদেশ বিভুঁইয়ে দেশকে কীভাবে খাটো করা যায়, সে ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত থাকলে দেশের মানুষের আপন হওয়া যায় না। অন্য দেশে যারা শান্তিতে নোবেল পান—প্রত্যেককেই দেখা যায়, দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা পালনের ব্যাপারে সচেষ্ট হতে। পৃথিবীতে একমাত্র ব্যতিক্রম নোবেলবিদ তিনি, যিনি নোবেল অর্জনের পর এ দেশের উন্নয়নে কোনো কাজ করেননি। সে কারণেই দেশের মানুষের কাছে তিনি প্রকারান্তরে মূল্যহীন হয়ে পড়েছেন এবং গায়ে মানে না আপনি মোড়ল—এ বাক্য ছড়িয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ড. ইউনূসের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়েছে সাধারণ জনতা। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর ফাঁকির মামলায় ড. ইউনূসকে সাড়ে ১২ কোটি টাকা রাজস্ব বোর্ডে জমা দিতে হয়েছে।
সাধারণভাবে দেখা যায়, বিচার কিংবা তদন্ত চলাকালীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিজ্ঞজনরা বিরত থাকেন। বিজ্ঞজনরা মনে করেন, তদন্ত চলাকালে কোনো বিষয় নিয়ে মতামত প্রদান করলে বিচার প্রক্রিয়ায় জড়িতদের মধ্যে এ বিষয়ে প্রভাব পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, সে কারণেই যারা নিজ নিজ বিষয়ে অভিজ্ঞ, তারা কখনোই বিচারকাজে মন্তব্য করেন না। বিজ্ঞ আদালতে মামলার বিষয়ে বাদী-বিবাদী দুপক্ষেরই আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। জজ সাহেবের বিচার অপছন্দ হলে ফের আপিলের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থায় মূলত এমনটিই হয়ে থাকে। এতদসংক্রান্তে যদি কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনা করে, সে ক্ষেত্রে বুঝতে হবে এখানে অন্য কিছু রয়েছে। বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনা, তার মানে এখানে আলাদা সিগনেচার রয়েছে। সম্প্রতি ড. ইউনূসের চলমান বিচারকাজ বন্ধে বিদেশি অনেকেই বিবৃতি দিয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আমেরিকায় কিছু দিন পরপর সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের ওপর স্কুলে ন্যক্কারজনক হামলা হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো বিবৃতি দিতে দেখা যায় না, ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা। উল্টো লবিস্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিদেশে প্রভাব বিস্তারের অপচেষ্টায় মত্ত থাকেন বিবৃতিদাতারা।
ড. ইউনূসকে নিয়ে বিদেশিদের বিবৃতি দেওয়ার পর সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে, এমন আশঙ্কার ব্যাপারে অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন; কিন্তু সরকারপ্রধানের দৃঢ় উচ্চারণে স্পষ্ট হয়েছে—বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হবে দেশের প্রচলিত নিয়মকানুনে, কারও বিবৃতি সেখানে প্রভাবক হিসেবে দেখা দিতে পারে না। সরকারপ্রধানের এমন দৃঢ় অবস্থান দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট অবস্থানকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আমরাও মনে করি, এদেশ আমাদের সবার; বিদেশি শক্তির দাপটে এ দেশ কখনোই পরিচালিত হতে পারে না। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হুমকির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের এ দেশের জনগণ বরাবরের মতোই ভবিষ্যতেও বয়কট করবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়