গুলশানের আলোচিত মাদক কারবারি শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসানকে ২০২১ সালের ৩ আগস্ট রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাস তিনেক ছিলেন কারাগারে। আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসেন, তারপর কিছুদিন ঢাকায় থেকে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন দুবাই।
গাজীপুরে ভুয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে একটি ব্যাংকের ৬৬ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় জামিন নেন মঞ্জুরুল আলম রতন নামে এক আসামি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান আরব আমিরাত।
এই দুই আসামির মতো গত ১০ বছরে ঢাকাসহ সারা দেশের অন্তত ৪২ হাজার আসামির হদিস মিলছে না। তাদের মধ্যে জঙ্গি, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ নানা অপরাধের আসামি রয়েছে। ওইসব আসামির আদালতে নিয়মিত হাজিরা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা গরহাজির বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানায়, যেসব আসামির হদিস নেই তাদের খুঁজে বের করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সব মহানগর পুলিশ কমিশনার, সব ইউনিট ও রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের। এলাকাভিত্তিক তালিকা করতে থানার ওসিদের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ সুপাররা। ইতিমধ্যে তালিকা তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রতিদিনই আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে আসছেন বিভিন্ন মামলার আসামিরা। জামিন মিললেও তাদের ধার্য তারিখে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধী থেকে শুরু জঙ্গি কিংবা বড় অঙ্কের প্রতারণার মামলার আসামিরা আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন না বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
মাসখানেক লাপাত্তা হওয়া আসামিদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য তালিকা করতে বলা হয়েছে পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিট ও দপ্তরকে। এমনকি যারা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন তাদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা নিতে বলা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু দেশ রূপান্তরকে বলেন, জামিন নিয়ে অনেক অপরাধী নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন না, তা সত্য। যে কোনো আসামি জামিন নেওয়ার সময় শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায়ই দেখা যাচ্ছে জামিনের পর অনেকেই শর্ত মানেন না। যারা জামিনের শর্ত মানছেন না তাদের আইনজীবীদের শোকজের আওতায় আনা প্রয়োজন। এই জন্য আমরা কাজ করছি।’
তিনি আরও বলেন, ওইসব আসামি আদালতে গরহাজির থাকলে তাদের গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করে আদালত। তাদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো কাজ করছে। জামিন নিয়ে অনেকে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। কয়েকজনের জন্য ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে সরকারি এই কৌঁসুলি বলেন,‘জামিন নিয়ে লাপাত্তা অপরাধীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে দেশের প্রতিটি আদালতকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। আমরাও বেশ সতর্ক আছি। ইতিমধ্যে লাপাত্তা হওয়া অপরাধীদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, গত দশ বছরে ৪২ হাজার আসামির হদিস মিলছে না। তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। আত্মগোপনে থেকে তারা নানা অপকর্ম করছে। বৈঠকে তাদের প্রোফাইল নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেসব অপরাধী জামিন নিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন না তাদের তালিকা আছে পুলিশের কাছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিদেশে পালিয়ে গিয়েও তারা রেহাই পাবেন না। ধরা পড়তেই হবে তাদের।’
তবে পুলিশ সূত্র জানায়, গত দশ বছরের ব্যবধানে লাপাত্তা ৪২ হাজার আসামি কোথায় আছেন তা চিহ্নিত করতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। তাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পুলিশের সবকটি ইউনিট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গুলশানের আলোচিত মাদক কারবারি মিশু হাসান কয়েক মাস ধরে লাপাত্তা। বর্তমানে তিনি দুবাই অবস্থান করছেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তার সঙ্গে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সুসম্পর্ক আছে। তার আরেক সহযোগী ও বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার বিরুদ্ধে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। বেশির ভাগ সময় তিনি দুবাই অবস্থান করেন। প্রায় একযুগ আগে রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় হোটেল সানরাইজে ডিবির দুই কর্মকর্তা খুনের মামলায় সন্ত্রাসী জিসান ও ইখতিয়ার জামিন নিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। মগবাজারের মোল্লা মাসুদও একইভাবে চলে গেছেন দেশের বাইরে।
এছাড়া রংপুরের ফারুক আহম্মেদ, শরিফ, খাইরুল ইসলাম, নাদিম, গাইবান্দার ময়েজ উদ্দিন, মহব্বত, নাহিদ, হামিদ শফিক, মিলন, সবুজ, সাজেদুর, মানিক, ঢাকার মাজিদ, কফিল উদ্দিন ওরফে রব মুন্সি, আজিবুল ইসলাম ওরফে আজিজুল, শাহান শাহ, হামিদুর রহমান, বজলুর রহমান, বাবর, সিরাজগঞ্জের আবদুল আজিজ, নরসিংদীর মোস্তফা কামাল, খুলনার মোহাম্মদ আবু তাহের, আবুল হোসেন ওরফে আবুল হাসেম, ফেনীর গিয়াস উদ্দিন, আবদুল আজিজ, জসিম উদ্দিন, চট্টগ্রামের সাখাওয়াত হোসেন, কামরুল ইসলাম, নুরুল আলম, কুমিল্লার দিদারুল আলম, ময়মনসিংহের আবুল কাশেম, কুমিল্লার ইউসুফ, হবিগঞ্জের নুরুল হক, মাওলানা আবু তাহের, মহিবুর রহমান, মৌলভীবাজারের আবদুল হক, বাগেরহাটের মমতাজ উদ্দিন, নাঈম, গোপালগঞ্জের খালেদ, দিনাজপুরের রাশিদুল ইসলাম, চাঁদপুরের আবু জিহাদসহ অন্যরা জামিন নিয়ে লাপাত্তা হয়ে আছেন। জঙ্গি নেতা ও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শুরা কমিটির সদস্য নওগাঁর আবদুল কাইয়ুম, কুমিল্লার আব্দুল হাই, কিশোরগঞ্জের মুফতি শফিকুর রহমান, নারায়ণগঞ্জের সালাউদ্দিন সালেহীন, কুষ্টিয়ার আবু সাঈদ শেখ, শরীয়তপুরের মালেক হোসেন, ঢাকার ধামরাইয়ের আব্দুল্লাহ আল সোহাইল, টাঈাইলের হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম দেশ ছেড়েছেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশের কাছে তথ্য আছে- রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া এলাকায় সক্রিয় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা), পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-জনযুদ্ধ), কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ কেন্দ্রিক নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (শৈলেন গ্র“প), ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এলাকায় গড়ে ওঠা শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন, বাংলাদেশ নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (গাজী-কামরুল), বাংলাদেশ নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (মৃণাল), গণমুক্তি ফৌজ, পাবনা ও কুষ্টিয়া এলাকায় সক্রিয় গণবাহিনী, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-রশিদ), সর্বহারা পার্টির বরিশাল, মাদারীপুর ও রাজবাড়ী গ্রুপ নামে সক্রিয় থাকা তিন অংশের অন্তত ৩ হাজার আসামি জামিন পেলেও নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যারা জামিন নিয়ে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন না তাদের তালিকা ধরে পুলিশ ও র্যাব অভিযান চালাচ্ছে। তারমধ্যে কারা কারা দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন তাদেরও একটি তালিকা আছে তাদের কাছে। ওই তালিকাটি তারা ইন্টারপোলের কাছে পাঠাবেন। এটা নিয়ে তারা কাজ করছেন।